কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন: বাংলাদেশের সংকট ও সম্ভাবনা
বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে দক্ষ ও অতি দক্ষ জনসংখ্যার হার অত্যন্ত উঁচু। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে প্রায় ৭৩ শতাংশ, জাপানে ৬৬ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৬৫ শতাংশ, এবং অস্ট্রেলিয়ায় ৬০ শতাংশ জনগণ দক্ষ। মালয়েশিয়ায় প্রায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি মাধ্যমে অধ্যয়ন করে। বিপরীতে, বাংলাদেশে স্বল্প দক্ষ ও দক্ষ জনশক্তির হার মাত্র ১৪ শতাংশ। এটি দেশের জন্য একটি উদ্বেগজনক চিত্র।
কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, এই শিক্ষাকে এখনো অবহেলা করা হয় এবং এটি অজনপ্রিয়। জনমনে এখনও কারিগরি শিক্ষা নিয়ে বিরূপ ধারণা রয়েছে। এর পাশাপাশি এই শিক্ষাব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা, যেমন শিক্ষার্থীদের উচ্চ ঝরেপড়া হার এবং ভর্তির সংকট, পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির সংকট
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলিতে ২০২২ সালে ৪৯,৮০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও, ২০২৩ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮,৬০০। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতেও একই চিত্র। ২০২২ সালে যেখানে ৫২,০০০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল, ২০২৩ সালে তা নেমে আসে মাত্র ৩০,০০০-এ। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা কমে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের নতুন পরীক্ষা পদ্ধতি এবং শিক্ষার মানের অবনতি। ফলে এই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা কমে যাচ্ছে।
কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব
অর্ধশতাব্দী পূর্বে দেশে সরকারিভাবে কিছু পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছিল। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্নকারীরা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। বিদেশেও এ ধরনের ডিপ্লোমাধারী শ্রমিকরা সাধারণ শ্রমিকদের তুলনায় দ্বিগুণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছে।
প্রাইভেট পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বর্তমানে পাঁচ শতাধিক। কিন্তু এর মান ও দক্ষতার ঘাটতি শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।
কারিগরি শিক্ষার সমস্যাগুলো
-
ভর্তির জটিলতা:
কলেজ এবং পলিটেকনিকের পৃথক ভর্তি প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। -
শিক্ষকের অভাব:
পর্যাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার মান কমে গেছে। -
যুগোপযোগী অবকাঠামোর অভাব:
ল্যাব ও প্রশিক্ষণ সরঞ্জামের অভাব শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। -
মানহীন কারিকুলাম:
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা পূরণে কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম যথেষ্ট আধুনিক নয়। -
নকল ও মূল্যায়ন জালিয়াতি:
পরীক্ষার মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে দুর্বলতা এই শিক্ষাব্যবস্থাকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
সম্ভাব্য সমাধান
-
জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে জনমনে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করা। -
একযোগে ভর্তি প্রক্রিয়া:
কলেজ ও পলিটেকনিকের ভর্তি প্রক্রিয়া একীভূত করা। -
শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ:
দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। -
অবকাঠামো উন্নয়ন:
আধুনিক ল্যাব স্থাপন এবং যুগোপযোগী সরঞ্জাম সরবরাহ। -
কারিকুলাম উন্নয়ন:
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা পূরণে কারিগরি কারিকুলাম আধুনিকীকরণ। -
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়ন:
সরকারি তদারকি বাড়ানো এবং মান নিশ্চিত করা।