প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষিত করা ও সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানুন।
প্রতিবন্ধী ব্যাক্তি আমাদের সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যারা শারীরিক বা মানসিক দিক থেকে বিশেষ কোনো অক্ষমতার শিকার। এই ব্যাক্তিদের জন্য বৈশ্বিকভাবে প্রচুর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও আমাদের দেশে এখনও তাদের জন্য সমান অধিকার, সুযোগ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অনেক বাধা রয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি শুধুমাত্র শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম নয়, বরং তাদের সঠিক সুযোগ, সমর্থন, এবং পরিবেশের অভাবে তারা আরও বেশি সমস্যার সম্মুখীন হন। যদিও আমরা সবাই জানি যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের মূলধারায় অংশগ্রহণের সমান অধিকার রাখে, তবুও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের অন্তর্ভুক্তি কম।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যাক্তির সংখ্যা ব্যাপক। বর্তমান বাস্তবতায় তাদের অধিকাংশই সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। কিন্তু আমাদের সমাজের দায়িত্ব এই ব্যাক্তিদেরকে মানবাধিকার ও সম্মানজনক জীবনযাপন নিশ্চিত করা। এই সম্পাদকীয়তে আমরা আলোচনা করব প্রতিবন্ধীদের অধিকার, তাদের জন্য সরকারের এবং সমাজের দায়বদ্ধতা এবং কীভাবে আমাদের সমাজে তাদের অবস্থান আরও উন্নত করা যায়।
প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সুরক্ষিত করা একটি বিশ্বজনীন বিষয়। ১৯৭৫ সালের ৯ ডিসেম্বর, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ "প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক বছর" ঘোষণা করে এবং পরে ১৯৯২ সালে প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় একটি আন্তর্জাতিক সনদ প্রণয়ন করা হয়, যার লক্ষ্য ছিল প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এই সনদ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধীদের জন্য সমান সুযোগ, চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস ২০২৪ উপলক্ষে ৩ ডিসেম্বর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গণমাধ্যম ও যোগাযোগ উন্নয়ন সংগঠন সমষ্টি “একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নেতৃত্বকে প্রসারিত করা” প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে একটি অনলাইন আলোচনা সভা করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও কল্যাণের প্রচার এবং সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এ সভায় বিভিন্ন জেলা থেকে ৫০ জন সাংবাদিক অংশ নেয় ।
২০০৬ সালে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষিত করতে "প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সম্পর্কিত কনভেনশন" প্রণয়ন করে। এই কনভেনশনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে সদস্য দেশগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেসব দেশে এই সনদে সই করা হয়েছে, সেখানে এখনও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশও এই কনভেনশনটির সইকারী দেশ, তবে এখানেও প্রতিবন্ধী জনগণের জন্য অনেক কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন হয়নি।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের বেশি। তবে সরকারি বা বেসরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। প্রতিবন্ধী ব্যাক্তির মধ্যে অধিকাংশই শহরের বাইরে বা গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে তাদের জন্য পর্যাপ্ত সেবা ও সুযোগ নেই। এই মানুষগুলো দেশের শিক্ষাপদ্ধতি, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য স্কুলে যাওয়ার সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর সংখ্যা অত্যন্ত কম। সরকার প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কিছু প্রকল্প চালু করেছে, তবে এগুলো অনেকাংশে অকার্যকর বা সীমাবদ্ধ। অনেক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়ার আগে বা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর নানা ধরনের শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধীরা খুব কম সুযোগ পেয়ে থাকেন। কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করলেও তা তেমন ফলপ্রসূ নয়। অনেক সময় প্রতিভাবান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতার কারণে চাকরি পেতে ব্যর্থ হন, যদিও তারা যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ।
সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তবে এই পদক্ষেপগুলো কতটা কার্যকরী তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। "প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইন" ২০১৩ সালে পাশ হওয়া একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। তবে এখনও পর্যন্ত এই আইনের বাস্তবায়ন খুবই সীমিত। সরকারের উচিত প্রতিবন্ধীদের জন্য আরো কার্যকরী এবং প্রভাবশালী নীতি গ্রহণ করা, যাতে তারা শিক্ষার অধিকার, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য সেবা এবং নিরাপত্তা লাভ করতে পারে।
এছাড়া, সরকারকে এই বিষয়ে আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান এবং পরিবহন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হলে, সরকারকে অধিক বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কাজের ক্ষেত্রেও বিশেষ কর্মসূচি চালু করা দরকার।
সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকেই প্রতিবন্ধীদের জন্য সহানুভূতিশীল হতে হবে। অনেক সময় সমাজে প্রতিবন্ধীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বা অবহেলা থাকে, যা তাদের আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে, যাতে তারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারেন।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকার, এনজিও এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে একযোগ হয়ে কাজ করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হলে মিডিয়ারও বড় ভূমিকা রয়েছে। সরকার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সামাজিক প্রচারণা চালিয়ে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহানুভূতির মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে, যাতে সবাই তাদের সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রযুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীরা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারেন। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কম্পিউটার সফটওয়্যার এবং হেল্পিং ডিভাইস সমুহ কাজে আসতে পারে, যা তাদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যদি প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন, তবে তারা নিজেদের সমস্যাগুলির মোকাবেলা করতে এবং আরও উন্নত জীবনযাপন করতে সক্ষম হতে পারেন।
অতীতে প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে এই অগ্রগতি এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আমাদের সমাজে এই ব্যাক্তিদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও জনগণকে একত্রে কাজ করতে হবে।
সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটি সমানাধিকার ভিত্তিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিগন সমাজের অমূল্য রত্ন। আমাদের উচিত তাদের মানবাধিকার রক্ষা করা এবং তাদের জীবনের মান উন্নত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার, সমাজ, এবং জনগণের মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার। যদি সমাজ প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের প্রতি সহানুভূতির মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে আমরা একটি অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তুলতে পারব