নারী শিক্ষার্থীদের হল জীবন: স্মৃতিময় সময় প্রবাহ

জিনিয়া (ছদ্মনাম): এই চলো, বিকেলে বের হই।
কনিকা (ছদ্মনাম): নাহ রে,এখন হাত খালি। যাবো না।
জিনিয়া: আরে চলো তো।আমি আছি না। আমি খাওয়াবো তোমায়...
উপরের কথোপকথনটি দুজন বান্ধবীর। তারা দুইজনেই একই হলের বাসিন্দা। রোজই এভাবে নানান গল্পে,হাসি-আনন্দে দিন কাটে তাদের। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে খুনসুটিতে সময় কাটায় হলের প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী। প্রিয় বান্ধবীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে অবসান ঘটে সারাদিনের চিন্তার। শত ব্যস্ততার মাঝেও অতিবাহিত হয় সময়।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আবাসিক শিক্ষার্থীদের একটি বড় সময় সাধারণত হলে কাটে। হলের জীবন মানেই অন্যরকম অনুভূতি। কতো শতো সুখ-দুঃখের স্মৃতি তৈরি হয় প্রতিটি মুহূর্তে। হলের প্রতিটি দেয়াল যেন প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকে। কখনো গলায় গলায় ভাব তো কখনো ঘটে যায় বিচ্ছেদের ঘটনা। কারো মধ্যে মনোমালিন্য হলে সামাল দেওয়ার ব্যাপারটিও জোশ। কখনো রুমমেট ,কখনো পাশের রুম থেকেও এসে মেটানো হয় ঝগড়া। এভাবেই দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটি,দুষ্টুমিতে সারাবছর মেতে থাকে হলের প্রতিটি কর্ণার।
বিভিন্ন উৎসবে হলের সৌন্দর্য নজর কাড়ে সকলের। নারী শিক্ষার্থীদের হাতের কোমল স্পর্শে নব যৌবনা হয়ে ওঠে প্রতিটি হল। রঙ-তুলির বাহারি আলপনায় কি সুন্দর যে সেজে ওঠে হলের প্রতিটি করিডোর,প্রতিটি দেয়াল,প্রতিটি কর্ণার সর্বত্র! সে যেন এক আলাদা উপন্যাস। রুমগুলোও রং-তুলির স্পর্শে রঙিন হয়ে থাকে সারাবছর। আসলে সবই নারীর শৌখিনতার বহিঃপ্রকাশ। বিভিন্ন ঋতুতে পিঠা-পুলির ধুম লেগে যায়,দেখলে মনে হয় সকলের মধ্যে কতই না মধুর সম্পর্ক। প্রতিটি হল যেন একটি পরিবার! অথচ সকলেই সীমিত সময়ের জন্য পড়াশোনার উদ্দেশ্যে হলে এসেছে। মেয়েরা এমনই! কতো সুন্দর মানিয়ে নেয় সবখানে।
হলের বাগানে ফুলের গাছ,বারান্দায় ক্যাকটাস-অ্যালোভেরার সমাহার হলকে করে সৌন্দর্যমন্ডিত। সন্ধ্যার পরে হলের বাউন্ডারি জুড়ে ঝিলিমিলি আলোর বাতিগুলো পুরোই রুপকথার মতো লাগে। হলের প্রতিটি শিক্ষার্থীর দৈনন্দিন জীবন যেন রুপকথার গল্পের একেকটি চরিত্র। এভাবেই সারা বছর জমজমাট হয়ে থাকে আবাসিক হলগুলো। আবাসিক হল শুধু একটি আবাসস্থল নয়, এখানে তৈরি হয় একটি দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। দেশকে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো প্রজন্ম পড়ে ওঠে হলের প্রতিটি আঙিনায়। হলের ডাইনিংয়ের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়েও দেশের কল্যাণে অবদান রাখার স্বপ্ন দেখে শিক্ষার্থীরা। খেয়ে-না খেয়েও পড়াশোনা করে অনেকে। দিনে ক্লাস-টিউশনি করে সারারাত পড়ে হাই সিজি তোলার গল্পও কম নেই।
হল হলো নানা মতের, নানা বর্ণের-বৈচিত্র্যের মানুষের মিলনমেলা। একদিকে কেউ চাকরির প্রস্তুতি নিতে দিনরাত খেটে পড়াশোনা করে। তো অন্যদিকে কেউ কর্পোরেট জবের আশায় বিভিন্ন সংগঠনে নিজের বিচরণ বাড়িয়ে চলেছে। প্রত্যেকেই প্রতিনিয়ত করে চলেছে অক্লান্ত পরিশ্রম। কেউ সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বালিশে মাথা রেখে শান্ত হয়। আবার কেউবা পারিবারিক অশান্তি, দাম্পত্য কলহ,ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রজনী কাটায়। কেউ আবার ছাত্রজীবন থেকেই বেছে নিয়েছে আয়-রোজগারের পথ। এখানে একদিকে যেমন সারাদিন পরিশ্রম করে সারারাত জেগে পড়াশোনা করা ‘ডার্ক সার্কেল’ পড়া নারীর দেখা মিলবে, তেমনি রূপচর্চা করে নিজেকে প্রতিনিয়ত গুছালো রাখার মতো শৌখিন নারীর দেখাও মিলবে অহরহ। এ জগতে হায় কতো বিচিত্র মানুষের বৈশিষ্ট্য। কতোই না বিচিত্র তাদের ব্যক্তিত্ব। এখানে তৈরি হয় অজস্র ভালোবাসার গল্প। সারাদিনের কাজের শেষে প্রিয়জনকে পরম যত্নে সময় দেয়, দুজনে মিলে স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর। প্রতিটি ঘটনাই আসলে একেকটি কাব্য,একেকটি উপন্যাস।
তারপর কখনো একাডেমিক পড়াশোনার গন্ডি পেরোলে চিরচেনা সেই হলের জীবন ইতি টেনে নেয়। ফুরিয়ে যায় খুব যত্নে আগলে রাখা সেই হল কার্ডটির মেয়াদ। সময় ফুরিয়ে যায়, অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। জীবনেও আসে কতো পরিবর্তন। শুধু হলগুলো পড়ে রয় সকলের পুরনো স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে। হলের অবকাঠামোতে কখনো পরিবর্তন হলেও মন থেকে স্মৃতি কভু সহজে মুছে না। পুরনো দেয়ালে রং করেই কি আর পুরনো স্মৃতি মুছা যায়! অবকাঠামো ভেঙে গেলেও স্মৃতি ঠিকই থেকে যায়। হয়তো বা কোনো ডায়েরির পাতায় অথবা মানুষের হৃদয়ে। একসময় দেশসেরা হওয়া সেই মেয়েরাও কি একটু অবসর পেলে স্মৃতিচারণ করে? কখনো কি ভাবে, ‘আহ! আমার ফেলে আসা হলের সেই সোনালী দিনগুলি!’