মানব সভ্যতার এই নিদর্শন অক্ষয় হোক

মানব সভ্যতার এই নিদর্শন অক্ষয় হোক

বাংলার মধ্যযুগের এক কবি বড় চণ্ডীদাস লিখেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ তাঁর এই বাণী কঠিন সত্য হয়ে আজো আছে আমাদের মনোজগতে। তাঁর ওই বাণী-ই বলে দেয় মানুষ-ই বিশ^ সভ্যতার অনন্য প্রতীক। সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের জীবনাচার-ই বিশ^ সভ্যতার ধারক ও বাহক। চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র তারই সাক্ষ্য বহন করে। মানুষ না থাকলে অন্য সবকিছু মিথ্যে হয়ে যেত। জংলী ও গুহা মানবের ইতিহাস থেকে আধুনিক সভ্যতায় ফিরে এসেছে মানুষ। মানুষকে তাই বলা হয় ‘আশরাফুল মখরুকাত’ মানে সৃষ্টির সেরা জীব।

সময়ের বিবর্তনে এই মানুষের মধ্যে বিভেদ, হিংসা, বিদ্বেষ বাড়তে থাকে। এখান থেকে নানা মত ও পথের সৃষ্টি হয়। মত, পথ, ধর্ম যা-ই থাকুক বিশে^র দেশে দেশে মানুষের জয়গান চিরস্থায়ী। যুদ্ধ-বিগ্রহ, উন্মাদনায় রক্তক্ষরণ, হত্যায় প্রাণহানী মানুষের দ্বারাই ঘটছে। আবার বিশ^শান্তির আহ্বানও মানুষ-ই জানিয়ে আসছে। তাই তো যুগে যুগে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের উপরে স্থান হয় মানুষের। ধর্মে ধর্মে হানাহানি, মারামারির পর আবার এক মোহনায় এসে দাঁড়ায় মানুষ। প্রকৃতির নিয়মে এক হয়ে যায় মানুষের জয়গান।

যেমনটা হয়েছে এবছর ৯ অক্টোর। মুসলমান ধর্মের মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মদিন (ঈদ-ই মিলাদুন্নবী), হিন্দু ধর্মের লক্ষিপূজা, খ্রিস্টান ধর্মের ইস্টার সানডে এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রবারণা পূর্ণিমা একই গ্রহ-নক্ষত্রের মিলন কেন্দ্রে এসে একাকার হয়ে গেছে। এই যে মাহামিলনক্ষণ, এটা মানব সভ্যতার অনন্য নিদর্শন। এর মাধ্যমে জাগতিক হিংসা, হানাহানি ভুলে মানুষ মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হবে। মানব সভ্যতার এই নিদর্শন অক্ষয় হোক।

ধর্মের মধ্যে সৃষ্ট বিভদে ঘোচানো সম্ভব হলে অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারতো। কিন্তু লোভ ও হিংসা আমাদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, 
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি
সব দেশে, সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি...’
পৃথিবীতে যদি মানুষই না থাকে তাহলে কিসের ধর্ম আর কিসের জাতপাত। সবার আগে মানুষকে নিয়ে ভাবতে হবে, তারপর তার ধর্ম। যখন মুসলিম জাতি হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মদিন উপলক্ষে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী পালন করছে, ঠিক সেই দিনই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পালিত হচ্ছে প্রবারণা পূর্ণিমা, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, ইস্টার সানডের নানা আয়োজন। ধর্মীয় রীতি অনুসারে এসব আয়োজনে ভিন্নতা থাকলেও সবকিছুর মধ্যে আছে মানুষ। তাই নজরুল বলেছেন-
‘মানুষের ঘৃণা করি
ও কারা, কোরআন, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি
ও মুখ হইতে গ্রন্থ কেতাব, নাও জোড় করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল, মুর্খরা সব শোন...’

তাই বলতেই হয় ধর্ম থাকুক যার যার ভেতরে। ধর্ম লালন করুক অন্তর দিয়ে। আর মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করে কল্যাণ কামনা করুক সবাই মিলে। মানুষ জীবনের জয়গান গায়। যুগে যুগে মানবের কল্যাণ কামনায় গীত হয় সাম্যের গান। জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সংস্কৃতি হয়ে ওঠে মানুষের মূল জীবনাচার। তাই সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা বিলুপ্ত হওয়া জরুরী।

বাংলাদেশ এমন এক অনন্য উদাহরণের দেশ হিসেবে সৃষ্টি হয়েছি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মূল মন্ত্রই ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। যেখানে সব ধর্মের মানুষ একজন অন্যজনের পরিপূরক হয়ে পাশে থাকবে। কেবল ধর্ম দিয়ে তাদের মধ্যে যেন হিংসা-বিভেদ, হানাহানি, রক্তপাত না ঘটে সেটি সন্নিবেসিত হয় মহান সংবিধানে। তারপরও লোভের আগুন আমাদের সেই সম্প্রীতির ঘর পুড়িয়ে দিতে থাবা বাড়ায়। এই অপশক্তিকে রুখে দিতে পারলে বাংলাদেশও পৃথিবীর বুকে মানব সভ্যতার অনন্য উদারহরণ হতে পারে। 

জগৎ ও জীবনচক্রের প্রাকৃতিক যে আবর্তন, তারই দৃষ্টান্ত হচ্ছে মানবসভ্যতা, সেই সভ্যতাই গুহামানবকে পৌঁছে দিয়েছে আধুনিক বিশে^র কারিগর হিসেবে। মানবজাতি-ই বিশ^সভ্যতার জন্য পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সেখানে বিশেষ গোত্র, সম্প্রদায়ের একক অর্জন নেই। তাই কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে সবকিছুর বিচার করলে সেটা হবে স্থূল চিন্তা। যা মানব কল্যাণে কোন অবদান রাখতে পারবে না। এই সত্য ধারণ করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

বহু বছর পর ৯ অক্টোর সব ধর্মের মানুষকে এক মোহনায় নিয়ে এসেছে। তাই ইতিহাসের পাতায় দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই দিন চার ধর্মের মানুষ বিভিন্নভাবে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দিনটি উদযাপন করেছে। সব ধর্মের ব্যাবধান ঘুচে মহামিলন কেন্দ্রে মিলিত হয়েছে মানুষ। তাই বলতে হয় এই ক্ষণে জয় হয়েছে বিশ^মানবতার। জয়ী হয়েছে মানুষ। এই মহামিলন অক্ষুন্ন থাকুক এটাই আমদের প্রত্যাশা।