শ্রদ্ধেয় ঘৃণা

ঢেউ,
বাবা দিবসে শ্রদ্ধা জানিয়ে পাঠকের জন্য লেখা আহ্বান করেছিল একটি জাতীয় পত্রিকা। তবে কেবল ‘শ্রদ্ধা’ নির্ধারিত হওয়ায় মনের সাথে বিপত্তিটা ঘটে যায় তখনই। যেটা অবশ্য প্রতি বছরই এ দিবসে নিয়ম করেই হয়। স্রোতের বিপরীতে লিখব কি লিখব না দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাদ দিয়েই লিখেছি। প্রতিক্রিয়া পুষে না রেখে প্রকাশ করাই উত্তম মনে হলো আমার কাছে। তবে বাবা দিবসে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখছি না, কারণ আমার মধ্যে থেকে শ্রদ্ধা শব্দটা বাবা শব্দের মতই অনেক কাল আগে থেকেই মৃত! হয়ত কোনো কোনো মৃত্যু দায় এড়িয়ে বেঁচে যাওয়ার সমান। আমার বাবা সেই দলেরই লোক।
বাবা শব্দটা মাত্র আমার মস্তিষ্কে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের দুই বোনের জন্ম হওয়ার কারণেই হয়ত তিনি বাবা হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছেন। তবে তিনি আরও কারো জন্য বাবা হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। অমি দেখেছি; দেখে যাচ্ছি- পরিবার শব্দটার দায় এড়িয়ে বাবা হয়ে থাকা কত সহজ। এমন বাবাদের কথা লেখার জন্য, বাবা দিবসে কোন আয়োজন হয় না। সকলেই শুধু শ্রদ্ধাই নিবেদন করতে আহ্বান করেন। কিন্তু আমরা অশ্রদ্ধাগুলো কোথায় লিখব?
এই বাবা দিবসে এমন বাবাদের জন্য পত্রিকায় একটা পাতা থাকুক। যেখানে এই বাবাদের কিছু অশ্রদ্ধার গল্প ছাপা হবে। জানুক এই প্রজন্মের সন্তানরাও। বাবাও ঘৃণার পাত্র হতে পারে। কারণ আগামীর সন্তানরাও একদিন হয়ে উঠবে কারো ‘বাবা’!
অনেক কিছুই লিখতে পারি। কেবল পারি না; বাবা শব্দের সাথে শ্রদ্ধা শব্দের মেলবন্ধন ঘটাতে। শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যে অনুভূতি গুলো দরকার সেগুলো আসবে কোথা থেকে বলুন? যদি বাবার প্রয়োজন গুগলে মেটানো যেত তবে হয়ত তাই করতাম! না! এখন আর প্রয়োজনবোধ করি না। প্রয়োজনগুলো না পেতে পেতে কখন যে অপ্রয়োজনে চলে গেছে টেরই পাইনি! তাই তো আমার কাছে ‘বাবা মানে রোজ সকালে পুতুল পুতুল খেলা নয়’ বরং শৈশবের প্রায় অনেক সকালেই দানবের মত চিৎকারে ক্রোধ আর শক্তির খেলা! আমার কাছে প্রাক শৈশবে বাবা মানে কাঁঠাল গাছ থেকে পাতাসহ ভেঙে আনা ডালের আঘাতে মায়ের আর্তচিৎকার! ভয়ে গুটিসুটি হয়ে দৃশ্যগুলো হজম করা! তারপর বাবা মানে শৈশবের আশেপাশে থাকা মানুষের নানা প্রশ্নের মিথ্যে উত্তর দেয়া। উত্তরটুকু অবশ্য মায়ের মুখস্থ করিয়ে দেয়া ছিল। সুবোধ বালিকাদ্বয়ের উত্তরগুলো ছিল এরকম- ‘বাবা ঢাকা কোম্পানিতে চাকরি করে, ছুটি পায় না তো তাই আসে না।’ তখন আসলে বুঝতামই না, কোম্পানি মানে কি? শুধু জানতাম এটা বলতে হবে। কারণ মায়ের শিখিয়ে দেওয়া! কৈশোরেও সেই একই প্রশ্নের উত্তর সুখী সুখী ভাব নিয়ে দেওয়া। আসলে অন্যের সামনে দুঃখবোধ জাগ্রত হলে খুব যে অস্বস্তিতে ভুগতে হয়। হয়ত ততদিনে সেটা শিখে গিয়েছিলাম।
আমার কাছে বাবা মানে মায়ের একাকিত্বের দীর্ঘ লড়াই। বাবা মানে মায়ের সেই সেলাই মেশিনটা! বাবা মানে ছিল মামা-নানা-খালা নামক মহীরুহের ছায়াতল! অজানায় হারিয়ে যাওয়া বাবাদের দায়িত্বভার বোধহয় কারণ ছাড়াই এদের উপর বর্তায়। জীবনের এই অংশটুকু বোধহয় খুব ভাগ্য করেই পেয়েছিলাম। তা না হলে হয়ত বেঁচে থাকার মূল ধারা থেকে অনেক আগেই ছিটকে পড়তাম! এরপর বাবা মানে ছিল বইয়ের বোঝা কাঁধে না চাপিয়ে তাঁর রেখে যাওয়া সংসারের বোঝাটা কাঁধে চাপিয়ে নেওয়া। তবে শেষ পর্যন্ত দুটোই চাপিয়ে নিয়েছিলাম। মায়ের সেলাই মেশিন আর তাঁর জীবন মেশিনটাকে একটু শান্তি দিতে। আমার কাছে বাবা মানে ক্লাস; শিক্ষক; ক্যাম্পাস; বন্ধু; আড্ডাহীন কতগুলো কাগজের সার্টিফিকেট অর্জন। বাবা মানে ঈদে খুব যত্ন করে মিথ্যে বলা; ‘বাবাতো ছুটি পায়নি’। ছোটবোনের মুখে হাতে গোনা কয়েকবার ‘আব্বু’ নামক শব্দটি শুনতে পাওয়া। কারণ ওকে এই ‘আব্বু’ নামক শব্দের লোকটিকে এককালে পরিচয় করিয়ে চিনিয়ে দিতে হয়েছিল!
বাবার উপস্থিতি ছাড়াই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। তাই আমার মা শাশুড়ি হলেও তিনি কিন্তু কারো শ্বশুর হতে পারেন নি। যদিও সেই বিয়েটা আর নেই। নেই মানে টিকিয়ে রাখি নি। হয়ত প্রকৃতির বিচারে এমনটা হয়েছে। পিঁড়িতে পা দিয়ে বুঝলাম আমি আমার প্রাক শৈশবের সেই ভয়ংকর সময়কেই পুনরায় বরণ করে নিয়েছি। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর মায়ের মত মহীয়সী হতে পারলাম না। আমি এখন প্রায় ছত্রিশ বছর পেরিয়ে। আমার কাছে বাবা মানে যে কোনো ঘৃণিত পুরুষ! আর অন্য পুরুষ মানে? সেইতো বাবার রুপই! এখন আমার কাছে বাবা মানে আমার মায়ের একাকী বৃদ্ধ হতে দেখা! ছোটবোনের বিদেশ বিভুঁইয়ে একাকী জীবনের যাপন! তবুও বেশ তো আছি! ভালোই আছি। তবু কেন ফিরে আসে ছোটোবেলার প্রশ্নগুলো? বাবা ছেড়ে গেলেও বাবা শব্দটা ছাড়ে না কেন? প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতে গেলে ঠিক চলে আসে। তবে হ্যাঁ; উত্তরের ধরণগুলো পাল্টিয়েছি এখন! এখন আর পারতপক্ষে মিথ্যে বলিনা। মাথা উঁচু করে বলে দেইÑতিনি এই পৃথিবীতেই বেঁচে আছেন। স্ত্রী সন্তানের সকল দায় এড়িয়ে তিনি দিব্যি বেঁচে আছেন! আরও কারো বাবা হয়ে কিনা তা জানি না।
এই বাবাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাবা দিবসে লিখব? শুনুন তাহলে; স্পষ্টকরে লিখছি- আমার কাছে বাবা মানে আমার পরিচয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি নামমাত্র, যে নামের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র কোনো শ্রদ্ধা নেই!!