বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো

বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো

বাঙালি বাংলাদেশ স্বাধীনতা। সেই উদিত সূর্যের আলো সকালের মিষ্টি আভা ছড়াতে ছড়াতে যখন মধ্য গগণের পথে, ঠিক তখনি হিংসা-দ্বেষ অকৃজ্ঞতা আর বেঈমানির তীব্র অমানিশা এসে ঢেকে দিতে উদ্যত হলো তার চলার পথকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবার, কর্নেল জামিল, আব্দুল নঈম খান রিন্টু এবং নাম না জানা এক তরুনসহ বকুলের রক্তে রঞ্জিত হল বাংলাদেশ।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫। এই একটি দিন বাঙালি জাতির সকল অর্জনকে সীমাহীন কলঙ্কে কলুষিত  করে নিন্দাপঙ্কে ডুবিয়ে দিল কতিপয় ঘাতক। তারপর কেটে গেছে অনেক দিন, অনেক বেলা। কত জেল জুলুম, আগুন, বোমা গ্রেনেড আরো অসংখ্য গুলির আঘাতে অকাতরে ঝরে গেছে কতশত নিরীহ প্রাণ। আর সেইসব অজস্র ত্যাগের বিনিময়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতাকামী বাঙালি। তারপরেও অদম্য সেই বাংলাদেশে আজো কারো কারো কথা আর কাজ দেখে খুব বলতে ইচ্ছা হয়, ‘যখন তোমার একটিও ফোটেনি আঁখি তখন কঠোর অপরাধ করিয়াছি।’ অনেকেরই হয়তো স্মরণ আছে মহাভারতের কাহিনীতে পুত্র বীরকর্ণের সামনে মাতা কুন্তির উচ্চারিত এই পংক্তিদ্বয়। 

আজ কেন যেন মনে হচ্ছে পঁচাত্তর পরবর্তী বংলাদেশে যখন মুজিব, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা এবং জয় বাংলা উচ্চারণ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যখন মনের ভিতরে সকল অব্যক্ত কষ্টের প্রজ্বলন পুঞ্জিভূত থাকতো, সেই অসীম দুঃসময়ে। হয়তো সেটা বিরানব্বই অথবা তিরানব্বই এর দিকে। ঢাকায় আলমগীর কুমকুমের সঙ্গে বরিশালের কমল সেনের যোগাযোগের পর হয়তো প্রথমে বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতি (বার লাইব্রেরীতে) এবং পরবর্তী সময় জাতীয় ছাত্রলীগের সদর  রোডস্থ সেই পড়োপড়ো দোতালা টিনের ঘরে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছিল বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বরিশাল।

তারপরে ভালোতে মন্দতে চলেছে সে, চলেছে ব্যাপক সংস্কৃতজনদের সহযোগিতায়। চলেছে মুজিব বিরোধী রাজনৈতিক স্রোতের বিরুদ্ধে, স্ব-মহিমায়। সকল বৈরীতাকে উপেক্ষা করে। না কোন বিশেষ রাজনৈতিক শক্তির সহযোগিতার অপেক্ষা করতে হয়নি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটকে কোনদিন। টানাটানি ছিল অর্থের। তাকেও সমাধান করেছে তারা কখনো নিজেদের সামর্থ দিয়ে, কখনো আপনজনদের কাছ থেকে পাওয়া যৎসামান্য অর্থ দিয়ে একান্ত নিভৃতে। 

আজ দু‘হাজার একুশের পনেরোই আগস্ট কেনই যেন মনে হচ্ছে সে দিনের কথাগুলো ভালো মনে রাখতে পারিনি আমরা। কখন যেন সমস্ত সাংস্কৃতিক দায়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, তাঁর প্রতি ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে, ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের কর্মে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে কোন কোন জোট নেতা! কখনো মনে হয়েছে, সে প্রয়োজন তাদের ছিলো সংস্কৃতিচর্চার আড়ালে জীবীকা অর্জনের জন্য। কখনো আবার কারো কারোরটা দেখে মনে হয়েছে নেহায়েত বোধবুদ্ধিহীন ভাব প্রদর্শনের নিছক প্রতিযোগীই তারা। এরকম বেশ কিছু অসামাঞ্জস্যতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট বরিশাল শাখা  এগিয়ে চলছিলো ভালোই।

তবে এবার এসে হঠাৎ করেই পুরোপুরি হোঁচট। পূর্বের সকল সরল অংক, কঠিন হয়ে উঠলো ক্রমশ। হাত বাড়ালেই যে টাকা, তা হলো না। ফোন দিলেই যে শক্তির উপস্থিতি, তাও হলো না। ইদানিং কোন কিছুই যেন মিলছে না কিছুতেই। হচ্ছে না প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তিযোগ। কেন এমন হলো? তবে কী অবিশ্বাস, সাংস্কৃতিক কর্মীদের যে সততা, যোগ্যতা, স্থিরতা, গভীরতা ছিলো, তা কী হারিয়ে গেল, কোন সাংস্কৃতিক নেতা বা নেতাদের আচরণে? যদি তেমনটা কারো ভাবনায় এসেও থাকে, হতাশ হবো না। মোটেই, বিস্মিতও হবো না। কেন হবো? সে অযোগ্যতার সাম্পান তো ভাসানো হয়েছে। এবার তাকে কেবল পদস্পর্শে ডুবিয়ে  দেওয়া হলো। আর তার জন্য কোথাও কোন প্রশ্ন নেই। 

এবার পনেরোই আগস্টের জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের অনুষ্ঠান বিশাল এক শোকের ব্যানারের পিছনে চাপা পড়ে হারিয়ে গেলো। কেউ কথা বললাম না। কোথাও উচ্চারিত হলো না একটি শব্দও। কোন রকম উদ্যোগ গ্রহণ করবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো না, ওই ব্যানার সরানোর। এ দেশের যে কোন রাজনৈতিক সময়ে কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী যা কোনদিন করেনি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে, এবারের পনেরোই আগস্টে তাই সম্ভব হলো। 

এ যেন ‘আমারই বধুঁয়া আনবাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া।’ এতোটাই অযোগ্য, অপাঙতেয় বনে গেলাম কখন জোটের অতি যোগ্য নেতৃত্ব? কেন এমন হলো, কেন অযথা মাথা বন্ধক দিয়ে চলা? কেন অতি আপনজন মিত্ররা বিভীষণ হয়ে আবির্ভূত হলো জোটের বিরুদ্ধে? যখন কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ ছিল, তখন আমরা রাস্তায় রাস্তায় পনেরোই আগস্টসহ সকল হত্যার বিচার চেয়েছি প্রকাশ্যে। অশি^নী কুমার হলে জায়গা বরাদ্দ না পেয়ে বিডিএস এ শোক দিবসের অনুষ্ঠানে বাচ্চারা অনবরত উচ্চারণ করেছে, ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই, মুজিব হত্যার বিচার চাই।’ যখন আর কোথাও জায়গা পাওয়া গেলো না, তখন প্রেসক্লাবে শোক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। যখন সেই অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণকারীদের আসতে পথে পথে বাধা দেওয়া হয়েছিল। যখন ঘাড় ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়তে হয়েছে আমাদের অনেককে। বাদ যাননি একুশে পদপ্রাপ্ত গুণীজন প্রয়াত নিখিল সেনও। সেই বঙ্গবন্ধু জোটের জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানের দিন অতবড় ব্যানার দিয়ে যারা অনুষ্ঠানস্থল ঢেকে রাখে, তারা বঙ্গবন্ধুর কেমন  সৈনিক? আজ বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে তাদের সম্পর্কহীনতা কোথায়? এ তো কোনদিন সম্ভব ছিলো না, কোন রাজনৈতিক দল কিংবা অন্য কারো পক্ষে! কিছুতেই বুঝতে পারছি না কেন এমন হলো? কেন রাজনীতি অনবরত দিচ্ছে ধমক, সংস্কৃতি যাচ্ছে পাস কাটিয়ে?

আসলে অতি অর্জনের প্রত্যাশায় এই স্খলন নয় তো? তা না হলে কি হতো? যা কেউ করেনি কোথাও কখনো। কেউ করছে না এখনো। এমন কি গোপালগঞ্জে টুঙ্গিপাড়ায়ও নয়। সেই কৃষকের জোয়াল টেনে টেনে এতোটা পথ এসেছি। প্রতি পনেরোই আগস্ট যথার্থ নিয়ম না মেনে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল আর একটি ছবির স্থান নির্ধারিত করেছি। আলোচনা ছিল, সমালোচনা ছিলো, হয়তো এখনো নিরবে আছে, তবু আমরা সেই ভুলকে শুদ্ধ জেনেই তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছি। আমাদের সেই পথেই দিনের পর দিন এই শহরের সকল শ্রেণি আর পেশার মানুষ শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করেছে। কোনদিন এখান থেকে পিছপা হয়নি বরিশাল আওয়ামী লীগও। এমনকি মেয়র শওকত হোসেন হিরনের সময়েও নয়। অথচ আজ দু‘হাজার একুশ এর শোক দিবস আমাদের বুঝিয়ে দিলো, শোক অনুষ্ঠানস্থল ব্যানার দিয়ে ঢেকে দিয়ে। বুঝিয়ে দিলো আওয়ামী লীগ বরিশাল, জোটের শোক অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধাঞ্জলি না দিয়ে। বুঝিয়ে দিলো  সেই নির্মম সত্য। জাতীয় শোকদিবস মানে শুধু মাত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ছবিতেই শোকার্ঘ দিতে হয়। একই স্থানে অন্য কারো ছবিতে নয়।

অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বিবির পুকুর সাঁতরিয়ে হিরন স্কয়ারে সামনে সোহেল চত্বরে জোটের শোক আয়োজনের প্রতিচ্ছবি নির্মাণ। আর এবার এসে দেখলাম বিশাল শোক ব্যানার দিয়ে অশ্বিনী কুমার হল চত্বরের শোক অনুষ্ঠানস্থান ঢেকে দেওয়া হলো। এই শহরে অন্য যে কেউ একাজ করলে মিছিল হতো, প্রতিবাদ হতো। আমি জানি না জোট নেতৃত্ব এখনো ভাবেন কি না সমষ্টিকে বাদ দিয়ে তারাই সব পারেন? এই প্রথম দেখলাম কোন সভা ডাকা ছাড়াই বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের শোক দিবস পালন! কিন্তু আমরা ভুলে যাই একদিন ‘চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে।’

তারপরেও বলি, ঠিক আগেরই মতো থাকবো, নাকি অপেক্ষায় থাকবো কেউ এসে আগামীতে বলবে, আপনারা এটা বন্ধ করে ওখানে আসুন। এমন ঘটনা ঘটে যাবার আগে আমাদের সমষ্টির কথা বলা প্রয়োজন। কি করবো, মেনে নেবো, নাকি পা বাড়াবো বঙ্গবন্ধু উদ্যানের পথে? যেখানে রাষ্ট্র প্রশাসন রাজনীতি সবাই। সেখানেই মূলত শোক ও শ্রদ্ধা জানানোর মূল স্থান। প্রধানমন্ত্রী তাই করেন, রাষ্ট্রপ্রতি তাই করেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও তাই করেন, সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মীরাও তাই করেন।

তবে আমরা কেন ভিন্ন পথে হাঁটলাম এতোকাল? আজ যদি কেউ এমনটা ভাবেন, ওই জোটের আয়োজনে আমরা কেন যাবো? তাহলে ভাবতে হবে উনিশ‘শ বিরানব্বই থেকে  দু‘হাজার একুশ আমাদের জন্য হয়তো আরো কঠিন হয়ে উঠবে। চলুন আগাই। আমাদের কোন অগ্রজ সংস্কৃতিক কর্মীদের অশ্রদ্ধা করার মানে আমাদের কারো বিজয় নয়। এখন চারিদিকে, ‘ধন আছে জ্ঞানের অভাব, ভবের কারখানায় ইহাই স্বভাব।’ ভুলের প্রকাশ যদি ঘটেই থাকে, শক্তি কৃপা যদি আবশ্যকতায় পর্যবসিত হয়েই পড়ে। তবে অজ¯্রবারের ন্যায় বোধ, বুদ্ধি, মান, সম্মান অবস্থান অস্তিত¦ সব জলাঞ্জলি দিয়ে শক্তির পদযুগলে ঝাঁপ মারুন। আর যদি মনে হয় জীবনে এতোটা পথ অতিক্রম করে আর কারো পা ধরে বাঁচা নয়। তবে আসুন, উঠে ঘুরে দাঁড়াই। শুধু একটু বিশ^াস করতে হবে, এই জোটের দু’একজন হয়তো পয়সা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা বিলাসীতার প্রয়োজনে আসে, তবে অধিকাংশই আসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসার টানে।

প্রমাণ করতে চেষ্টা করি অনরবত শক্তি, দম্ভ, অর্থের দুয়ারে আর নৈবেদ্য নয়। এবার বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের নিজ সামর্থের প্রসাদ নিয়ে সামনে আগাই। মানুষ গ্রহণ করবে। কেবল সম্প্রসারিত জৌলুসের প্রসার অমাদেরকে শক্তি-দুয়ারের ভিক্ষুক বানিয়ে ছাড়ে। কি দরকার! যা সত্য তার আবার ছোট বড় কি? সত্য উপস্থাপনের জন্য দরকার সত্যের, সেখানে রঙ অপ্রযোজনীয়। কি দরকার রঙের? যে রঙ কাজ শেষে আমাদের অর্থাৎ সাংস্কৃতিক কর্মীদের অচ্ছুত, কালো থেকে মহাকালো, আর পদলেহনকারী মনে করে। সেই ডাকে সাড়া দেবার জন্য আমাদের পা স্থিরতা হারাবে কেন বার বার?

ত্রিশ চল্লিশ বছরের মুষ্টির চাল যেন-তেন পাত্রে আর নয়। না বলতে শিখতে হবে। কেবল অনুষ্ঠানের ঔজ্জল্যতা আর সম্প্রসারণই সদা সর্বদা কাম্য নয়। কর্মীদের স্থান দিতে হবে। অনন্তকাল এই ধরণের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন যা লাভজনক নয় আর্থিক, সেই পদ আগলে থাকলে ঘুরে ফিরে কারো না কারো পায়ের জুতার আলিঙ্গন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। শরীরে অযোগ্যতার শ্যাওলা জমে জমে একশত বছরের পুরাতন পুকুর ঘাটলার রূপ ধারণ করবে। হয়তো ইতিমধ্যে অনেকেই তেমনই হয়ে পড়েছি আমরা। তা না হলে এতো অবজ্ঞার পরেও কষ্ট অনুভূত হয় না কেন, ঘুরে দাঁড়াতে ইচ্ছা হয় না কেন? কেন বলতে পারি না, ‘হাত পাতি মানে ভিক্ষা করি না।’ এই ভিক্ষাবৃত্তির পথ পরিহার করে কাজ করে যেতে হবে স্বকীয়তায়। বুঝিয়ে দিতে হবে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অর্থ-বিত্তে খাটো হতে পারে, তার অর্থ তারা ভিখারী নয়। যাতে করে কেউ হাঁক দিয়ে বলতে না পারে ‘আসো, এসে বসে থাকো ঘন্টার পর ঘন্টা। তার পরে খুশি হও টাকা নিয়ে।’ তবু উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছি না, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের করেছো অপমান, অপমানে তাদের হতে হবে সবার সমান।’ এই এতো রাগ, নিরন্তর অব্যক্ত ক্ষোভ আর কষ্টের কথাগুলো যখন মনকে দারুন অসহায় করে তুলছিলো, ঠিক তখনই খবর মিললো বরিশাল সদর উপজেলার সামনে বিসিসির পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং ইউএনওর বিষয়টি। 

ঠিক জানি না কেন? বিসিসির পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা রাতের আঁধারেই পরিচ্ছন্নতার এমন তাগিদ অনুভব করলো? জানি নিয়ম প্রচলিত আছে। সে তো ডাস্টবিন পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজনে। ভালো করে বোঝা হলো না, কেন ওখানের ওই ব্যানারই কেন? কি ছিলো সদর উপজেলা কমপ্লেক্সের ব্যানারে? পনেরোই আগস্ট উপলক্ষে কি ওই ব্যানার? বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিলো তো? না কি অন্য কারো ছবি, যা প্রাসঙ্গিক নয় এই শোক দিবসের ব্যানারে? যাকে ময়লা আবর্জনা ভাবা যায়, যাকে উপড়ে ছিড়ে ফেলে দিলে সবকিছু পরিচ্ছন্ন হয়? নাকি ওই ব্যানারে অন্য কোন নাম ছিল যে নামের মানুষদের বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া এ দেশে আইনত নিষেধ! রাজনৈতিকভাবে নিষেধ, আছে কি? যদি তেমনটা হয়ে থাকে তা হলে ঠিক আছে। তারপরেও ঠিকটাকে ঠিকঠাক রাখতে কাজটি রাতে নয়, সূর্যলোকে দিনের ফকফকা আলোতে করতে হয়। তা না হলেই বুঝতে অসুবিধা হয়। যেমন বুঝতে দারুন অসুবিধা হচ্ছে আনসার সদস্যদের হাতের বন্ধুক থেকে গুলি ছোড়ার কাহিনীটি। কেন কিভাবে এতো প্রয়োজন তৈরি হলো। কারা তৈরি করলো, তারা কি পরিচ্ছন্নতা কর্মী করপোরেশনের, যারা এতো দামি বাইকে চলে? সময় গড়াতেই ধীরে ধীরে পরিচ্ছন্নকর্মীরা পরিস্কার হয়ে উঠতে লাগলো। কেউ কেউ বলতে লাগলো, এরা ছাত্রলীগ, যুবলীগ আওয়ামী লীগ। এটা কি করে সম্ভব? নিশ্চয়ই এটা বিরোধীদের অপপ্রচার।

আসলে কোন কোন ঘটনার আকস্মিকতা পক্ষ বিপক্ষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আবার কারো না করো হারিয়ে যাওয়া অবস্থান ফিরিয়েও দেয়। আঠারো তারিখের ঘটনা প্রবাহে তেমন বেশ কিছু বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। আমরা শুনেছি, এই শহর আওয়ামী রাজনীতির অনেকেই অনেক দিন যাবত সিটি মেয়রের অতি আশীর্বাদে রাজনীতি শুন্য হয়ে দূরে দূরে হাঁটতে বাধ্য হয়ে ছিলেন। তারা প্রায় সবাই এই ঘটনা প্রবাহের বাধ্যবাধকতার তাগিদে ফুরফুরে, ধোপদস্তুর পরিধানে এসে বসে পড়েছেন মেয়রের পক্ষের সঠিকতা উন্মোচনে। এবং  মেয়রের মুখে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন সেই কথা, কি সে কথা? ‘আমি পুরো ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই!’

এই হলো রাজনীতি। এ কেবল সম্ভব রাজনীতিবিদের দ্বারা। এ অসাধারণ রাজনীতি সহজ নয় রাজনৈতিক জমিদারীতে। এ খেলা বুঝে উঠতে অনেক রাজনৈতিক জমিদারদের অনেক সময় লাগবে। শিখতে হবে, বুঝতে হবে। সামন্তযুগীয় আধিপত্য এখন আর সম্ভব নয়। এখন হুট করে রাস্তা বন্ধের চিন্তা করবার আগে মাথায় আসতেই হবে লেবুখালিতে অবস্থিত শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টের কথা। যাদের গাড়ির একটি টায়ার সারাতে হলেও এই শহরে আসতে হয়। তাছাড়া রাজনৈতিক সংস্কৃতিই তো হচ্ছে সকল চিন্তার, সিদ্ধান্তের সুসমন্বয়। কখনোই নিয়ন্ত্রণ নয়। কার নামের ব্যানার কোথায় উড়লো তাকে টেনে নামাতেই হবে, এমন বুদ্ধির যোগানদাতারা রাজনীতির নয় তোষামোদীর যোগান দেন। তাকে আমলে নিলেই বিপদ।  সেই দুরভিসন্ধির ফাঁদে কেউ পা দিলে সেই পা পিছলে কতোদূর পর্যন্ত যেতে পারে, তা দেখলো বরিশাল এবং ভাগ্যবিড়ম্বিত এই শহর বেকুবের মত তা উপলব্ধি করলো আঠারোই আগস্ট রাতে, বরিশাল সদর উপজেলা কমপ্লেক্সের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনায়।

আমরাও দেখলাম, বুঝতে চেষ্টা করলাম রাষ্ট্র প্রশাসন এবং রাজনীতির সেই অদ্ভুত পথ চলা। একদিকে ইউএনও’র বাড়িতে বিসিসি’র পরিচ্ছন্নতা কর্মীরূপী দলীয় নেতা কর্মীদের হামলার অভিযোগ। অন্যদিকে মেয়র পক্ষের সংবাদ সম্মেলনের এই দাবিকে অস্বীকার করে ইউএনও’র নির্দেশে তাদের উপর গুলিবর্ষণের অভিযোগ। স্তম্ভিত হয়ে দেখলো শহর। ক্ষুব্ধ রাজনীতি, ক্ষুব্ধ প্রশাসন, ক্ষুব্ধ মেয়র। আছে আর একটি পক্ষ। যারা মূলত একেবারেই দৃশ্যমান নয়।  সেই অদৃশ্যকে শত্রু ভেবে, তাদের জাতীয় শোক দিবসের অতি সামান্য আয়োজনকে ষড়যন্ত্র ভেবে, তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এক অপরিনামদর্শী কর্মের এই ব্যর্থ পরিনাম। ‘হয় ধান, নয় প্রাণ’ পরিস্থিতিতে উত্তেজনা যখন এতটাই টানটান, ঠিক তখন বোধোদয় হল উভয় পক্ষের। ততক্ষণে ঘটনার রেশ এ শহর ছাড়িয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পর্যালোচনায় চলে গেছে। ইতোমধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে খবর, দশ প্লাটুন বিজিবি এবং দশ জন ম্যাজিষ্ট্রেট এই ঘটনা নিয়ন্ত্রণে বরিশালের পথে। অপেক্ষার উত্তেজনায় কাঁপছে শহর। 

সেই অভাবিত সময়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আশীর্বাদ  পৌঁছালো শহরে। ঘোষণা এলো। ‘এটা সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝি!’ আমরা বুঝতে বাধ্য হলাম ইউএনও’র বাড়িতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরূপী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হামলা ছিল ভুল। সেই হামলাকারীদের ওপর আত্মরক্ষার্থে ইউএনও’র নির্দেশে আনসার সদস্যদের গুলি চালানো ছিলো ভুল। এই খবরে মেয়রের খুব দ্রুত ঘটনাস্থলে বাইকে ছুটে আসাটা ছিল ভুল। তার পরিচয় পাওয়ার পরেও (নেতাদের ভাষ্য মতে) আনসারদের উপর্যপুরী গুলি ছোড়া ছিলো ভুল। উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের নির্বিচারে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের উপরে লাঠিচার্জ এবং গুলিবর্ষণ ছিল ভুল। 
অতএব, চটজলদি এই সমস্ত ভুলগুলোকে বুঝে শুনে পরিশুদ্ধ করতে একত্রিত হল প্রশাসন রাজনীতি এবং মেয়র। তারা একত্রিত হল বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনে। ভালো  বোঝা গেল না। এটা কি ভুলকে পরিশুদ্ধ করবার আত্মিক তাগিদ, নাকি উপরেরও উপর থেকে আসা নির্দেশ? তা না হলে কি করে এত ক্রোধ এত দ্রুত প্রশমিত হয়ে গেল? বোধ করি একেই বলে ক্ষমতা! 

যার চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে এক সারিতে এক ফ্রেমের একই ছবিতে আর্বিভূত হল সবাই। দেখলো শহর, দেখলো দেশ, সেই শান্তিস্থাপনের ছবি। এর পরেই এতো উঁচু মাত্রার ভুলগুলো পরের দিন সূর্যালোকে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই সঙ্গে মুছে গেলো গুলির আঘাতে দুই রাজনৈতিক কর্মীর চোখের আলো। এই সমস্ত কর্মযজ্ঞের নাম ছিল ভুল!
যদিও সেই ভুলগুলোর শুদ্ধ পথে কিছুটা সময় অন্ততো হাঁটবার একটা সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনীতি বোঝা নেতারা। শুধু ভুল হয়ে গেল দলের সেই সকল কর্মীদের যারা আদেশের স্থূলতা এবং গভীরতার পার্থক্য অনুধাবন করতে না পেরে, ঢুকে পড়েছিল ইউএনও’র বাড়িতে এবং ঘটনার আকস্মিকতায় পড়ে গিয়েছিল গুলির সামনে।  তারা বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কোন গুলি? কে ছুড়লো, কেন, কার বিরুদ্ধে? 

এমন প্রশ্নগুলো মানুষের মুখে মস্তিষ্কে হাহাকার করে ফিরছে নিঃশব্দে। তখনই সহজ সরল মানুষেরা বুঝে নিয়েছে এবং স্পষ্টতই বুঝে নিয়েছে এ সকল ভুল সব বোঝাবুঝির উর্ধে। কারো কাছে এটা ছিলো খেলা, ফলাফল দুই দুইএ অমিমাংশিত। কেউ কেউ মনে করছে পরাজিত হয়নি মেয়র, বিজয়ী হতে পারেনি প্রশাসন। তাহলে কি হলো? এরই নাম কি ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো?’


লেখক: আজমল হোসেন লাবু, সংগঠক ও বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য