আন্তর্জাতিক যুবদিবস, নারী-যুববান্ধব শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে

আন্তর্জাতিক যুবদিবস, নারী-যুববান্ধব শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে

১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস। করোনা বিশ্বে এবারের প্রতিপাদ্য, ‘খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তরকরণ: মানবস্বাস্থ্য এবং গ্রহসংক্রান্ত উন্নয়নে যুব-সমাজের উদ্ভাবন’। যুব বলতে সাধারণত ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের নারী-পুরুষদের বোঝানো হয়। তবে করোনায় গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে কিশোরী নারী ও যুবকরা। সেক্ষেত্রে তবে ১৪ থেকে ২১ বছরের তরুন ও কিশোর-কিশোরীরা শঙ্কা ও ঝুকির মধ্যে রয়েছে। করোনায় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে নারী স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং সার্বিক নিরাপত্তার অজুহাতে বাল্য বিবাহসহ কিশোরী নারীরা চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। দীর্ঘদিন স্বশরীরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে থাকা, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা এবং ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জে দেশের নারী শিক্ষার্থী ও যুবকরা মানসিক ও আর্থ-সামাজিক গভীর সংকটপূর্ণ সময় পার করছে। আন্তর্জাতিক যুব দিবসে শিক্ষার্থীসহ কিশোরী নারী ও তরুনদের মানসিক সংকট দূর করতে উদ্যোগ নেওয়া অতি জরুরী। কারণ তারাই আগামীর বিশ্বকে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। এজন্য প্রয়োজন নারী-যুববান্ধব শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ সৃষ্টি।

তারুণ্যের বিকাশ ও উন্নয়নে ১৯৯৮ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অব মিনিস্টার রেসপনসিবল ফর ইয়ুথ’ ১২ আগস্টকে ‘আন্তর্জাতিক যুব দিবস’ হিসেবে উদ্যাপনের প্রস্তাব করে। পরের বছর ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক যুব দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিনটি পালন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ তরুণদের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই যুব উন্নয়নের বিষয়ে এখন অধিকতর মনোযোগী। বাংলাদেশের ‘জাতীয় যুবনীতি’ অনুসারে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারী-পুরুষদের ‘যুব’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ হিসাবে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই যুব জনতা।

সম্ভাবনাময় দেশে বিদ্যমান যুবশক্তিকে উন্নয়ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করার প্রয়াসে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘ ১৯৮৫ সালে আন্তর্জাতিক যুববর্ষ ঘোষণা করে। শান্তি, অর্থনৈতিক গতিশীলতা, সামাজিক সুবিচার, সামাজিক সংহতি ও সহনশীলতা প্রধানত নির্ভর করছে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের তারুণ্যের শক্তির ওপরে। এখন বিশ্বের ৪০ কোটিরও অধিক তরুণ নারী ও পুরুষ সশস্ত্র সংঘাত কিংবা সংঘবদ্ধ সহিংসতা সহ্য করে বাস করছেন। নিজেদের অধিকার প্রশ্নে তরুণ প্রজন্মের লক্ষ লক্ষ সদস্য বঞ্চনা, হয়রানি, চোখ রাঙানি এবং অনান্য সামাজিক গণতান্ত্রিক নীতি লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণ, নারী ও কিশোরীরা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

বর্তমান বিশ্বে ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সের মধ্যে ১৮০ কোটি (১ দশমিক ৮ বিলিয়ন) যুবক-যুবতী রয়েছেন যা এ যাবৎ নবীন মানুষের সর্ববৃহৎ জনসংখ্যা। তবে, এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে বর্তমান বিশ্বে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী সমস্ত শিশু এবং কিশোর-কিশোরীর অর্ধেকেরও বেশি প্রাথমিক শিক্ষা, ন্যূনতম পড়াশোনা এবং প্রাথমিক গণিতে ভয়ানক দক্ষতার অভাব রয়েছে, যদিও তাদের বেশিরভাগই বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। এই বৈশ্বিক শিক্ষার সঙ্কট মারাত্মকভাবে অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে উঠবে।

তাই জাতিসংঘের পরিকল্পনায় দশটি ক্ষেত্র, অর্থাৎ- শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, যুব সমাজে মাদকের অপব্যবহার, কিশোর-কিশোরী অপরাধ, অবসরের কর্মকা-, বালিকা, যুব, মহিলা এবং সমাজ জীবনে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুবকদের পূর্ণ এবং কার্যকর অংশগ্রহণ বিষয়কে অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এই বছর, আন্তর্জাতিক যুব দিবস কার্যত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং শিশু ও যুবদের জন্য ইউরোপীয়ান ইয়ুথ ফান্ডের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ডেসা দ্বারা আয়োজিত হবে। নারী এবং মেয়েরা  জীবদ্দশায় তাদের পুষ্টির চাহিদা সম্পর্কিত অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। শৈশবে অপুষ্টির প্রভাব বিশেষভাবে ক্ষতিকারক হতে পারে। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাব দুর্বলতা বৃদ্ধি এবং শারীরিক বিকাশ, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং দুর্বল স্বাস্থ্য এবং মৃত্যুর ঝুঁকির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

করোনাকালে অর্থনীতি হয়েছে বিধ্বস্ত। বিপর্যস্ত হয়েছে বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ। আর এর অনিবার্য প্রভাবে বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধির প্রসার ঘটেছে।

গত ১১ মার্চ বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) এক গবেষণায় বলা হয়, ২০২০ সালে করোনার সাত মাসে দেশের ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। ‘বাল্যবিয়ের অবস্থা দ্রুত বিশ্লেষণ: করোনাকাল ২০২০’ শীর্ষক এক জরিপটিতে বলা হয়েছে, করোনাকালে নিম্ন আয়ের মানুষ নানা ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল আয় হারানো, ক্ষুদ্র ব্যবসা ধ্বংস ইত্যাদি। করোনাকালে দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও পরিবারের সদস্যদের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা করতে নাপারা বাল্যবিবাহের বড় কারণ হিসেবে বর্ণনা করে ৩০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।

করোনাকালে বাল্যবিবাহের অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে আয় হারিয়ে দারিদ্র্য বৃদ্ধি, বিদ্যমান সামাজিক নিয়ম-বিশ্বাস, স্কুল বন্ধ, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে অভিভাবকদের কিছু সুবিধা পাওয়ার আশা, কম পরিমাণ যৌতুক দেওয়ার সম্ভাবনা। আর এতে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য। কর্মসংস্থান যুব উন্নয়ন এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার (ঝজঐজ) এবং লিঙ্গ সমতার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত; জলবায়ু সংকট এবং দুর্যোগ বিশ্বব্যাপী সেবায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

বাল্যবিবাহের মতো সমস্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি করোনাকালে বেড়েছে নারী নির্যাতনও। বিশ্বের যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি, সেসব দেশের তালিকায় সম্প্রতি এসেছে বাংলাদেশের নাম। দেশের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই জীবনে কখনো না কখনো সঙ্গীর হাতে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিশ্বের ১৬১টি দেশ ও অঞ্চলে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আলাদাভাবে করোনা মহামারির মধ্যে সর্বশেষ ১২ মাসে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারীর শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ তালিকায়ও ১৬তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। করোনাকালে দেশে ২৩ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

করোনাকালে দেশে জনসংখ্যার হার কাঙ্খিত মাত্রার চেয়ে বেড়ে গেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যহত হওয়ায় গত বছর প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার অতিরিক্ত শিশুর জন্ম হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউএনউইমেনের গত বছরের জুন মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ নারী তাঁদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার সামগ্রীর অপ্রতুলতার কথা বলেছেন, বিশেষ করে নারীপ্রধান পরিবারের কাছে এ সমস্যা প্রকট। ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ: র‌্যাপিড জেন্ডার অ্যানালিসিস’ শিরোনামে ওই গবেষণাটি ছিল জেন্ডার ইন হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ নামের একটি জোটের উদ্যোগ।

নিম্ন বা স্বল্প আয়ের নারীরা কীভাবে তাঁদের মাসিককালীন ব্যবস্থাপনা করছেন, তা জানতে গত বছরের মে মাসে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশ একটি গুণগত গবেষণা করে। তাতে দেখা যায়, নিম্ন আয়ের নারীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব প্রকট।

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি রওশন আরা বেগমের মতে, ‘করোনাকালে গর্ভপাতের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। বেড়েছে ঘরে সন্তান জন্ম দেওয়ার হার। এসবের প্রভাব নারীস্বাস্থ্যের ওপর পড়েছে। মাসিককালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল, এরও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। তবে তা কতটা পড়েছে, তা বলার মতো পর্যাপ্ত গবেষণা আমাদের হাতে নেই।’

তরুণরাই বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইউএনএফপিএ বিশ্বাস করে যে তরুণদের ক্ষমতায়ন করা উচিত এবং উদ্ভাবনী সমাধানগুলি চালানোর জন্য তাদের সমর্থন করা উচিত যা তাদের সম্প্রদায়ের অভিযোজিত ক্ষমতা উন্নত করবে। এই প্রক্রিয়ায় তাদের সম্ভাব্যতা এবং ভূমিকা অনুধাবন করার জন্য, সঠিক, মানবাধিকার ভিত্তিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা এবং তথ্যে প্রবেশাধিকার একটি অপরিহার্য ভিত্তি হবে। একইভাবে, কর্মসূচী সরকারকে লিঙ্গ সমতা এবং নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন বাড়াতে সহায়ক হবে।

আইনী সংস্কারের পাশাপাশি ব্যাপক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনে সহায়ক পদ্ধতির বিকাশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষায়  মেয়ে শিশুর প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত এবং উন্নীত করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে পিতা-মাতা এবং অন্যান্য আইনগত অভিভাবকদের ভূমিকা, আত্মমূর্তি, আত্মসম্মান এবং মর্যাদা শক্তিশালী করতে এবং মেয়েদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ রক্ষায় উন্নতি ও সমর্থনে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। যুব সমাজ মানেই ছেলেমেয়ের সমান অংশীদারত্ব, এটি সর্বজন স্বীকৃত হতে হবে। তাহলেই যুব সমাজের অংশগ্রহণে জাতিগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।