দশমিনায় ফুলেল শুভেচ্ছা নিয়ে আনন্দের পাঠে ফেরা

দশমিনায় ফুলেল শুভেচ্ছা নিয়ে আনন্দের পাঠে ফেরা

পটুয়াখালীর দশমিনা মডেল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রোববার সকাল সাড়ে ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরন করে নিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক সালা উদ্দিন সৈকত। বিদ্যালয়ের সূচি অনুযায়ী ক্লাস শেষ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যেতে হবে। বিদ্যালয়ে বসে আড্ডা বা কোনো গল্প করা যাবে না। অবশ্যই মাস্ক পরে আসতে হবে। উপজেলার আব্দুর রসিদ তালুকদার ডিগ্রী কলেজের ও ক্লাসরুম সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। দীর্ঘদিন পর শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যেন কোনো শূন্যতা অনুভব না করে সে জন্য এ আয়োজন।

শুধু এই দুই প্রতিষ্ঠানেই নয়, দীর্ঘ দেড় বছর করোনায় বন্ধ থাকার পর সারাদেশের স্কুল-কলেজের ক্লাসরুম খুলে দেওয়ার প্রাক্কালে দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ছাত্রছাত্রী এবং তাদের সঙ্গে আসা সবাইকে অবশ্যই মাস্ক পরে আসার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জানানো হয়েছে, স্কুলে মাস্ক ছাড়া এলে কাউকে ঢুকতেই দেয়া হবে না। উপজেলার একাধিক স্কুলে গিয়ে রঙিন বেলুনসহ নানা উপকরণ দিয়ে সাজাতে দেখা গেছে। স্কুলে শিশু-কিশোররা যেন নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করে, সে জন্য করিডোরে দাগ দিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে ফটকে বড় করে ব্যানার টানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘নো মাস্ক, নো স্কুল’। অর্থাৎ মাস্ক ছাড়া এলে কাউকে ক্লাস করতে দেয়া হবে না। স্কুল খোলা নিয়ে বাংলা বাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর বাবা নিজাম উদ্দিন রাড়ি বলেন, স্কুল বন্ধ থাকায় বাচ্চারা অস্থির হয়ে গেছে। ওদের বাসায় আটকে রাখা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। স্কুলও খুলছে  কিন্তু করোনার যে খবর শুনছি, তাতে ওদের স্কুলে পাঠানোর সাহস হচ্ছে না তবু পাঠাতে হবে।

গছানী মাধ্যমিক কিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মো. নাজমুল হক বলেন, আমার মেয়ে ১০ম শ্রেনীতে পড়ে। আমি তাকে স্কুলে পাঠাছি। কিন্তু অনেক অভিভাবকই আছেন যাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তারা তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাইছেন। আর কয়েকজন অভিভাবক বলেন, কয়েক দিন দেখে তারপরসন্তানদের  স্কুলে পাঠানো শুরু করবেন।

গছানী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শান্তা, রুমা, সাওন, নিরব চন্দ্র ও বিশু বলেন, দীর্ঘদিন পর আমাদের বিদ্যালয় খুলছে। আমাদের কাছে অনেক ভালো লাগছে। আমরা স্কুলে যাচ্ছি, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। আবার এক সঙ্গে পড়াশোনা ও খেলাধুলা করতে পারব। এটা আমাদের জন্য খুবই আনন্দের। বাড়িতে বসে থাকতে আর ভালো লাগে না।

এদিকে, শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দেয়া ছাড়া স্কুলে পাঠাতে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় স্কুল কলেজ পড়–য়া অনেক অভিভাবকরা। এমনকি স্কুল-কলেজগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরিভাবে মানা হবে কিনা- তা নিয়েও সন্দিহান তারা। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিন পর ক্লাসরুম খুলে দেয়া হলেও আনন্দের পাশাপাশি শঙ্কাও আছে। তবু ঘটছে দীর্ঘ অপেক্ষার সমাপ্তি। ৫৪৩ দিন বা এক বছর পাঁচ মাস ২৪ দিন বন্ধের পর শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত স্কুল-কলেজ। প্রসঙ্গত, করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর ২৩ দফা বাড়ানো হয় ছুটি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও ২০২০ সালের এসএসসি-এইচএসসি ও সমমানের শিক্ষার্থীদের অটোপাস দেয়া হয়।

জানা যায়, উপজেলায় ১৪৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক-ইবতেদায়ী মাদ্রাসাসহ প্রায় ৪০টি বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে ১১ দফা নির্দেশনা। চলতি বছর ও আগামী বছরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস হবে প্রতিদিন। অন্যান্য শ্রেণির ক্লাস সপ্তাহে একদিন। প্রাথমিক সমাপনী ও বার্ষিক পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনুষ্ঠিত হবে। তবে করোনা সংক্রমণ আবার বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফের বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে শুক্রবার জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। একই কথা শনিবার জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রবেশের সময় ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। এদিকে শিক্ষার্থী কিংবা পরিবারের কেউ অসুস্থ বা করোনার উপসর্গ থাকলে তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পাঠাতে অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়গুলো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।

সংশ্লিষ্টদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও ঝুঁকি কিন্তু রয়েই গেছে। তবু শুরু হচ্ছে ক্লাসরুমে পাঠদান। প্রস্তুত অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্কুলে ফিরতে উন্মুখ শিক্ষার্থীরাও। এজন্য মানতে হবে নানা বিধিনিষেধ। শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে ৬৩টি নির্দেশনা। বদল আসবে, স্কুল-কলেজের চিরায়ত অনেক নিয়মকানুনে। 
মডেল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ সালা উদ্দিন সৈকত বলেন, ইতোমধ্যে প্রায় শতভাগ শিক্ষক-কর্মচারীকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। আর স্বাস্থ্যবিধি যেন কঠোরভাবে মানা হয়, সেজন্য তদারকি দলও গঠন করা হয়েছে। এবং ক্লাসরুমকে বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে। আর শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যেন শিক্ষার্থীদের কোনো চাপ না দিয়ে পড়াশোনাকে আনন্দদায়ক করে তোলা হয়।

গুলি আউলিয়াপুর সরকারি প্রঅথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুর রহমান জানান, সরকারের নির্দেশনা মেনে প্রতিটি বিষয় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সব শিক্ষক-কর্মচারী টিকা নিয়েছেন। বিশেষ করে হাত ধোয়া এবং মাস্ক পরার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। স্কুল প্রাঙ্গণে হাত ধোয়া ও তাপমাত্রা পরিমাপ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুল খোলার খবরে ঘরবন্দি শিক্ষার্থীরা যেমন আনন্দে উদ্বেলিত তেমনি উচ্ছ্বসিত শিক্ষকরাও। শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীরাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তাদের পদচারণায় শ্রেণিকক্ষ মুখরিত না থাকলে পাঠদানের ‘মজাটা আসে না’। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের তিনজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপকালে তাদের এমন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। তবে স্কুল আবার শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হবে। এটা একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। কিছুটা কষ্ট হলেও শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে ভালো লাগছে।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস নিতে প্রাথমিক অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দেয়া নিয়মনীতিতেই শিক্ষার্থীদের ক্লাস হবে প্রতিদিন। তবে করোনা সংক্রমণ আবার বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফের বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আসলে বন্ধ করে দেয়া হবে। 
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সেলিম মিয়া বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নির্দেশনা রয়েছে। তবে করোনা সংক্রমণ আবার বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফের বন্ধ করার সিদ্ধান্ত আসলে বন্ধ করে দেয়া হবে।