শিক্ষক নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বরিশালে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চ গঠন

শিক্ষক নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বরিশালে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চ গঠন

সারা দেশে অব্যাহত শিক্ষক নির্যাতন, হত্যা এবং সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন সাংস্কৃতিক সংগঠক ও কর্মীরা। এসব ঘটানার প্রেক্ষিতে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহকে এক জোট হয়ে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন বরিশালের সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। এর প্রেক্ষিতে উদীচীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বরিশালেও গঠিত হয়েছে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চ।

বৃহষ্পতিবার ২৮ জুলাই সন্ধ্যায় উদীচী ভবনে বরিশালের সকল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংস্কৃতিক মঞ্চ থেকে একযোগে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

প্রবীণ আইনজীবী, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মানবেন্দ্র বটব্যালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন, শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারের সভাপতি নাট্যজন সৈয়দ দুলাল, বরিশালের সাংস্কৃতিক সংগঠন সমুহের জোট বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ও খেলাঘর জেলার সভাপতি নজমুল হোসেন আকাশ, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট বিশ^নাথ দাস মুনসী, বরিশাল নাটকের সভাপতি কাজল ঘোষ, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক তপংকর চক্রবর্তী, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সভাপতিম-লীর সদস্য ও বরিশাল থিয়েটারের সভাপতি শুভংকর চক্রবর্তী, প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি অপূর্ব গৌতম, সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ চক্রবর্তী, প্রান্তিক সংগীত বিদ্যালয়ের অ্যাডভোকেট দেবাশীষ দাস, তানসেন সঙ্গীত বিদ্যালয়ের সভাপতি প্রিয় লাল দাস, বিনয় ভূষণ ম-ল, চারুকলার অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র দাস, স্বর্ণালী শিল্পী সংস্থার মিন্টু কুমার কর, খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক অপূর্ব রায় সহ অন্যরা।

মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিগঠনের কারিগর, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যান সেই শিক্ষকদেরকে অপমানিত করা, তাদের উপর হামলা-নির্যাতন-নিপীড়ন-হত্যার ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ধর্মের নামে একের পর এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরির মাধ্যমে জাতিকে অসহিষ্ণু করে তুলছে। তারা কখনো প্রগতিশীল শিক্ষকদের উপর, কখনো অমুসলিম সম্প্রদায়ের উপর এধরনের হামলা-নির্যাতন পরিচালিত করছে। দেশজুড়ে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক তা-বের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে দ্রুত বিচারের আওতায় নিতে না পারলে স্বাধীনতার মূল্যবোধ যতটুকু অবশিষ্ট আছে তাও ধুলিস্যাৎ হবে।

তারা বলেন, দেশে শিক্ষক লাঞ্ছনা, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যার যতো ঘটনা ঘটেছে, অবিলম্বে তার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে তার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত, এসব ঘটনার পেছনের পরিকল্পনাকারী, ইন্ধনদাতা, উস্কানিদাতা এবং হামলাকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মতনিবনিময় সভা থেকে আগামীকাল শনিবার সকাল ১০টায় অশি^নী কুমার হল চত্ত্বরে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মঞ্চের ব্যানারে সাংস্কৃতিক সমাবেশ আহ্বান করা হয়েছে। এ ছাড়া অব্যাহত শিক্ষ নির্যাতন, হত্যা এবং সাম্প্রদাকি উগ্রতা রুখে দিতে আগামী ৩১ জুলাই সকাল ১০টায় স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর স্মাকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকায় প্রগতিশলী সাংস্কৃতিক মঞ্চ গঠিত হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বরিশালেও উদীচী সমমনা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিনিধিদের নিয়ে মতবিনিময় সভার মাধ্যমে বরিশালেও প্রগতিশলী সাংস্কৃতিক মঞ্চ গঠন করেছে। এই মঞ্চে প্রগতিশীল শিক্ষক সংগঠন ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকলকে যুক্ত হয়ে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
১. গত কয়েক বছরে 

২. ওয়াজ মাহফিলসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে উষ্কানিমূলক বক্তব্য বা আলোচনা নজরদারিতে এনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একইসাথে ভবিষ্যতে যাতে কেউ এধরনের ঘটনা না ঘটাতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। 

৩. ফেসবুকসহ সামাজিক গণমাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননার নাম করে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪. এপর্যন্ত যতোগুলো শিক্ষক লাঞ্ছনা, নির্যাতন, নিপীড়ন বা সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রেই পুলিশ ও প্রশাসনের অবহেলা এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের যুক্ত থাকার বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। তাই ভবিষ্যতে দেশের কোথাও কোনো সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটলে সেটি প্রতিরোধে ব্যর্থতার দায়ে সেখানকার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

৫. যেকোন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটার পর ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে, তা কোনোভাবেই সরকারি কোষাগার থেকে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেয়া যাবে না। বরং যারা হামলা করেছে তাদের কাছ থেকে এই অর্থ আদায় করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। 

৬. স্বাধীনতার অন্যতম মৌল চেতনা ছিল সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত সমাজ গঠন করা। এ কাজে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকসংস্কৃতি। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল, মুর্শিদী, মারফতিসহ মাটির সুরের লোক গান বা যাত্রাপালার মতো সুস্থ ধারার সংস্কৃতি। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় তা চর্চ্চার পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে। সেই পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধসম্পন্ন সাংস্কৃতিক বলয়, কেন্দ্র ও মুক্তমঞ্চ গড়ে তুলতে হবে। 

৭. মহান মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতিকে পুন:প্রতিষ্ঠায় সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টি করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাাসিত অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত, বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ক্রিয়াশীল সংগঠনসমূহকে মুক্তভাবে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। দেশের জনগণের মানবিক সমৃদ্ধি ঘটাতে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে জাতীয় বাজেটের এক শতাংশ বরাদ্দ দেয়ার দাবি করছি। 

উপরোক্ত দাবিসমূহ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চেতনা এবং পবিত্র সংবিধানের চার মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে তা প্রতিরোধ করতে হলে অবাধ সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক চর্চার কোনো বিকল্প নেই। তাই, উপরোক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়নে আপনার সক্রিয় পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে নি¤েœ স্বাক্ষরকারী সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দ।