৭১ ও ৭৫ পর ২১ আগস্ট আবারও ঘাতকরা রক্তাক্ত করলো ঢাকা

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেল। ঢাকার আকাশটা শরতের ছোঁয়ায় আচ্ছাদিত ছিল। নীল আকাশে সাদা মেঘ শুভ্র আভা ছড়াচ্ছিল। শরতের শুভ্র আলোয় ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কারণ ছিল আওয়ামী লীগের সমাবেশ। সমাবেশের প্রায় শেষ পর্যায়ে বক্তব্য রাখছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি ট্রাকের ওপর তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে তিনি বক্তব্য দেবার সময় তাকে ঘিরে ছিলেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। হঠাৎ প্রচ- বিষ্ফোণের শব্দে কেঁপে ওঠ পুরো এলাকা। এক মুহূর্তে রক্তে লাল হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। একজনের ওপর অন্যজন রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। ৭১, ৭৫ এর পর আবারও ঘাতকরা রক্তাক্ত করলো ঢাকার রাজপথ। ওই নারকীয় ঘটনা পাকিন্তানী হায়নাদের চেয়েও ভয়াবহ। পরে অবশ্য পুরো বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ জুড়ে রক্তের দাগ আর পড়ে থাকতে দেখা গেছে জুতা-স্যা-েল। প্রকাশ্যে দিনের বেলো কেবল রক্তের হলি খেলা দেখার জন্যই ঘটানো হয় ওই নির্মমতা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশে আর একটি কালো অধ্যায়ের নাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর জন্য ছক সাজানো হয়েছিল। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছিল। এবারের পরিকল্পনায় ছিল তখন দেশের বাইরে থাকা বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে নারকীয় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানো। সেই লক্ষ্যে বিদেশ থেকে অত্যাধুনিক গ্রেনেড আনা হয়েছিল। ছক অনুযায়ী সেদিন আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলের চারদিকে খুনিদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। মূল লক্ষ্য ছিল সভা মঞ্চ, যেখানে তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য রাখছিলেন। ঘাতকদের ইশারায় একে এক ১৩টি গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয় সমাবেশমঞ্চ ও আশপাশে। ওই নির্মতায় প্রণ দিতে হয়েছে অন্তত ২৪ জনকে। পঙ্গু অবস্থায় এখনও যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। এই বর্বরোচিত হামলা ও হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানায় গোটা বিশ^।
ইতিহাসের নারকীয়, নির্মম ও জঘন্য হত্যা দিবস একুশে আগস্ট। গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ওই নারকীয় হত্যা ঘটনো হয়। যার মাধ্যমে আর একটি ১৫ আগস্ট সৃষ্টি করতে চেয়েছিল ঘাতকরা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে একুশ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারই পুনরাবৃত্তি ঘটনোর চেষ্টা ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট। বিদেশ থেকে আনা গ্রেনেড চার্জ করে কাঁপিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার রাজপথ। পরিকল্পিতভাবে একটি রাজনীতির অপমৃত্যু ঘটাতেই নারকীয় ওই গ্রেনেড হামলা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
নির্মম ওই হত্যাকা-ে তখনকার মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মীনী আইভি রহমানসহ ২৪ জন গ্রেনেডের ষ্পিøন্টারের আঘাতে রক্তাক্ত জখম হয়ে মারা যান। তার মধ্যে ঘটনাস্থলে ২২জন মারা যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আইভি রহমান ও আরও একজন মারা যান। এখনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক নেতা-কর্মী শরীরে স্পিøন্টার বহন করে বেঁচে আছেন। অনেকে পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর ওই জনসভায় ১৩টি গ্রেনেড ছোড়া হয়। যার মধ্যে ১২টিই বিস্ফোরিত হয়। এটা ইতিহাসের আরেক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।
সেদিনের ঘাতকরা নিশ্চিত হয়েছিল শেখ হাসিনা বেঁচে নেই। কিন্তু ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আজকের প্রধানমন্ত্রী ও সেদিনের বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। মূলত আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, দলের তখনকার সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়া, ঢাকার তখনকার মেয়র মো. হানিফ, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, শেখ ফজলুল হক সেলিমসহ দলের নেতারা মানববর্ম তৈরি করে তাঁকে রক্ষা করেন। কিন্তু গ্রেনেডের ষ্পিøন্টারের আঘাত সহ্য করতে হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের। স্পিøন্টারের আঘাতে শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হয় মেয়র মোহাম্মদ হানিফকে।
আজ ভয়াল সেই ২১ আগস্ট। ২০০৪ সালের ঘটনা আমাদের আজও হতবাক করে। যারা এই আগস্ট সৃষ্টির নায়ক তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে হত্যার এই রাজনীতি থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে না। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট আর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট একই সূতোয় গাঁথা। দুই হত্যাকা-ের কুশিলবরা আমাদের একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধ পরিপন্থি। এরা যদি কোন রাজনীতির লোকও হয় তাহলেও বলতে হবে এরা ঘৃণ্য ও জঘন্য অপরাধী। এদের বিচার না হলে সত্যিকারের রাজনীতির পথ সুগম হবে না। রাজনীতির বাঁকে বাঁকে কেবল এক একটি আগস্ট সৃষ্টি হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে যেন আর কোন আগস্ট সৃষ্টি না হয় সেজন্য কঠোর হতেই হবে।