টিআইবি সদস্যদের বার্ষিক সভার ঘোষণা দুর্নীতি মুক্ত, সুশাসিত, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ

আমরা টিআইবির সদস্য হিসেবে ‘বার্ষিক সভা ২০১৯-২০২০ এর সমাপ্তিতে সম্মিলিত ঘোষণা করছি যে, আমরা দুর্নীতিকে সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করি, ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে দুর্নীতি থেকে বিরত থাকতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নিজ নিজ অবস্থান থেকে একক ও সমষ্টিগতভাবে দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে আরও বেগবান ও কার্যকর করতে আমরা একযোগে কাজ করতে সচেষ্ট ও সক্রিয় থাকবো। আমরা আমাদের বিবেককে চির জাগ্রত রেখে অন্য সকলের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে দুর্নীতি প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করবো। টিআইবি যেমন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্মোহ থেকে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ থেকে বিরত থাকতে বদ্ধপরিকর একইভাবে সংস্থাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত সদস্যবৃন্দও ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
বৃহষ্পতিবার ২৬ নভেম্বর ২০২০ তারিখ ঢাকায় অনুষ্ঠিত টিআইবি সদস্যদের বার্ষিক সভায় ওই ঘোষণা দেওয়া হয়। টিআইব সদস্যদের বার্ষিক সভার ঘোষণা নি¤œরূপ।
করোনা সংকটকালে স্বাস্থ্য খাতে সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ চাই:
কোভিড-১৯ গভীরভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য খাতের করুণ অবস্থাকেই সবার সামনে তুলে ধরেনি বরং এই সংকটকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং তা ব্যবহার করে নিজেদের আখের গোছানোতে সুযোগসন্ধানী, দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতির সুবিধাভোগীরা দুর্নীতির মহোৎসবে নেমেছে। নকল মাস্ক থেকে শুরু করে নি¤œমানের পিপিই কিংবা করোনো সংক্রমণের টেস্ট রিপোর্ট বা করোনা চিকিৎসার অতিরিক্ত ব্যয় কোনো কিছুই বাদ যায়নি দুর্নীতির প্রবল গ্রাস থেকে। যা স্বাস্থ্যখাতে আস্থার সংকেেক প্রকট থেকে প্রকটতর করে তুলেছে। এই ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার কোনো দৃষ্টান্ত যেমন ছিলো না তেমনি কোনো নিয়ন্ত্রণ, তদারকিও ছিলো না বললেই চলে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নামে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভাগীয় পদক্ষেপের অংশ হিসেবে কেবলমাত্র বদলি এবং ওএসডি নির্ভর এক ধরণের আনুষ্ঠানিকতা দেখা গেছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তির নমুনা আমরা দেখতে পাই নি।
আমরা শুরু থেকেই দেখতে পাই যে, সরকার করোনা ভাইরাস মোকাবিলার বদলে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখাটাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে এবং এক ধরনের সংকোচনমূলক নীতি অবলম্বন করেছে। ফলে, তথ্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং স্বাস্থ্যখাতে জনগণের অভিগম্যতা কমে গেছে। সনাক্তের সংখ্যা উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে এবং এটিকে রাজনৈতিক সাফল্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহারের প্রবণত্ওা দেখা গেছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি উন্নয়নে করোনা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে যে বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়েছে তা বাতিল করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে ক্রয়ে তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে এবং অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত সাময়িক বরখাস্ত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণসহ মামলা পরিচালনা করতে হবে। এসব জনপ্রতিনিধিদের পরবর্র্তী যে-কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা বাতিল করতে হবে। সম্মুখসারির সকল স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাপ্য প্রণোদনা দ্রুত বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। একইসাথে দেশজুড়ে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতার জন্য সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
গণমাধ্যমের ওপর চাপ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত ও আত্মঘাতিমূলক:
দেশে মৌখিকভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্ত গণমাধ্যমের প্রচার থাকলেও বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় পদ্ধতিতেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। বিশ^ মুক্ত গণমাধ্যমের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ১৫১তম অবস্থান প্রমাণ করে যে, সাংবাদিকতা এদেশে ধারাবাহিকভাবেই কঠিন হয়ে উঠছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য বিভিন্ন আইনের চাপে গণমাধ্যম নিজেও ‘সেল্ফ সেন্সরশিপে’ গুটিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, যা স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। গণমাধ্যমের ওপর চাপ গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত, যা আত্মঘাতীমূলক ও বুমেরাং হতে বাধ্য। তাই অবিলম্বে মুক্ত সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্ত করতে আমরা সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কাছে জোর আহ্বান জনাই। নাগরিক সমাজের পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও সংবিধানস্বীকৃত নাগরিকের চিন্তা, বাক্ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতের দাবি উত্থাপনে সোচ্চার হতে হবে এবং সাংবাদিকতার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকার ও অংশীজনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে:
সারা বিশে^ এই করোনায় নারীর প্রতি সহিংসতা শতকরা ২০ ভাগ বেড়ে গেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশেও পরিস্থিতি ভিন্ন কিছু নয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৯২ জন। এই সময়ে পারিবারিক সহিংসতায় শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১৮৯ জন নারী। করোনা সংকটের কারণে যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় সব ঘটনা যে আলোর মুখ দেখেছে, তা আমাদের বিশ^াস করতে কষ্ট হচ্ছে। করোনার ফলে প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থাও আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। করোনার প্রভাবে কাজ হারিয়ে পুরুষ হতাশায় ভুগছে অন্যদিকে নারীও তার উপার্জন থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে যৌতুকের দাবিসহ নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমরা মনে করি। একইসাথে, ধর্ষণের ঘটনায় ন্যায় বিচার নিশ্চিতের অভাবে ক্রমান্বয়ে এই সামাজিক ব্যাধি মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। আর তাই, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে অপরাধীর যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই বলে আমরা মনে করি।
কোভিড-১৯ এর ন্যায় বৈশি^ক বিপর্যয় মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় চাই তরুণদের অংশগ্রহণ:
পুরো বিশে^র মতো কোভিড-১৯ বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক ও গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। সমাজের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়লেও বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য ঝুঁকিটা বেশি। অতিমারি পরিস্থিতিতে তরুণদের চাকুরীর ক্ষেত্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে; নতুন ও অভিনব কর্মক্ষেত্রে অভিগম্যতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনাময় তরুণদের সিংহভাগই পিছিয়ে আছে। নতুন স্বাভাবিকতায় বাজারে যে নতুন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হবে, একদিকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পুঞ্জীভূত দুর্বলতা ও অন্যদিকে দীর্ঘদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে যুক্ত না থাকায় সেটি অর্জনও তরুণদের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে তরুণ সমাজকে নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের মধ্যে ২০টিতেই সরাসরি তরুণদের কথা বলা হয়েছে। তাই এসডিজি অর্জনের সক্রিয় অংশীজন হিসেবে যুব সমাজ যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নীতি ও কৌশল প্রণয়ন, কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ এবং তার বাস্তবায়নকারীর ভূমিকা পালনে সক্ষম হতে পারে তার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতি বন্ধ করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতা হ্রাস এবং উন্নত ও টেকসই নীতি-কৌশল নির্ধারণে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে-কোনো ধরনের অসঙ্গতি নিয়ে তরুণ সমাজ যাতে সমস্ত ধরনের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে নির্বিঘেœ তাদের মতামত প্রকাশ ও প্রতিবাদ করার আইনি অধিকারের চর্চা করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ একই ধরনের অন্যান্য আইনের বিতর্কিত ধারাসমূহ বাতিল করতে হবে।
চাই কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানের বিকাশ:
একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থাকে বলা হয় জবাবদিহিতার প্রথম ও অপরিহার্য উপাদান। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার অন্যতম সূচক নির্বাচন পদ্ধতি। প্রশ্নবিদ্ধ একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে বিশেষত আইন প্রণয়ন, বাজেট প্রণয়ন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা আরও জোরদার হয়েছে। অন্যদিকে নিয়মরক্ষার প্রধান বিরোধীদল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাঁদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি দৃশ্যমান। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন যে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সেই সত্যটাও কমিশন সংশ্লিষ্টরা সম্ভবত ভুলে গেছেন। বাংলাদেশে একসময় নির্বাচন যে একটি উৎসব হিসেবে বিবেচিত হতো, তা বর্তমান কমিশন যাদুঘরে পাঠাবার বন্দোবাস্ত পাকাপোক্ত করেছেন বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের পূর্বশর্ত হিসেবে জাতীয় সততা ব্যবস্থার সকল প্রতিষ্ঠান, যাদের ওপর জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়ন এবং আইনের শাসন ও জবাবদিহিমূলক সরকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে তাদের, বিশেষ করে- প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করার দাবি করছি, যেন তারা স্বাধীন ও কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে।
ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারায়, চাই সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা:
রাষ্ট্র মালিকানাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে জনগণের অর্থ ও আমানত নিয়েই ব্যবসা করে থাকেÑ এই বাস্তবতার স্বীকৃতি বাংলাদেশে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের স্বেচ্ছাচারী প্রবণতায় মনে হয়, ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের অর্থ যেন কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ, যা তাদের খুশিমত ব্যবহার করা যাবে। আবার ব্যাংক মালিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকারÑ এই তিন পক্ষও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ যে জনগণের সম্পদ সেটি ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী তথা ঋণ খেলাপিদেরকেই ক্রমাগতভাবে সুযোগ করে দিচ্ছে। অনেক সময় তারা ঋণ খেলাপি, জালিয়াতিকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী ও অর্থ পাচারকারীদের সহায়ক শক্তি হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। এমনকি সরকারকেও তাদের কাছে জিম্মি মনে হয়। যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানত তদারকি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করাÑ তারাও নেতৃত্বের অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণ খেলাপিদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাই এই সংকট থেকে উত্তরণে অবিলম্বে সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি কমিশন গঠন করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনাসহ কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে চাই কার্যকর পদক্ষেপ:
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের জবাবদিহিতার জায়গাটা এমন এ পর্যায়ে আটকে আছে যে সেখানে শুধু চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি হচ্ছে। রাঘব বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। একটা ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে আরেকটা নতুন ঘটনায়। দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে যারা অভিযুক্ত হচ্ছেন, যাদের ধরা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে কিছুটা তৎপর হয়। এই তৎপরতা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যম বা নি¤œমধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা দু-একজন ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু ঘটনার পেছনের রুই-কাতলাদের কিছুই হয় না। এর কারণ হচ্ছে প্রভাবশালীদের যারা এসব অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ হোক, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার একটা সূত্র পাওয়া যায়। প্রশাসনিক দিক থেকেও একই অবস্থা চলে আসছে। প্রশাসনও তাদের সুরক্ষা দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। দুর্নীতির মূল হোতা রাঘব বোয়ালরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। সে কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়টি ক্রমশই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এসবের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় আছে। এক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের যথেষ্ট আইনগতভিত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি দমনে যে আইনি এখতিয়ার দেওয়া আছে তার যথাযথ প্রয়োগ হলে দেশে একটার পর একটা দুর্নীতির ঘটনা ঘটত না।
চাই সুশাসিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ:
কোভিড-১৯ উদ্ভূত সংকটে জর্জরিত জাতির ক্রান্তিকালে জবাবদিহিতাহীন ও স্বেচ্ছাচারের অনেক অমানবিক দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের স্বার্থে এখনই এই প্রবণতার লাগাম টেনে ধরার জোরালো আহ্বান জানাচ্ছি। সরকারের সামগ্রিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত অবস্থান কেবল তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে কী-না এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমরা মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে সততা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, জবাবদিহি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে সকল প্রকার শোষণ ও বৈষম্য অবসানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে একযোগে কাজ করা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে স্কুল পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করার জন্য আহ্বান জানাই। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সুশাসন এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ, আদিবাসী, বাঙালি, প্রতিবন্ধী বা অন্য যেকোনো পরিচয় নির্বিশেষে সকল মানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। আমরা চাই ন্যায়ভিত্তিক, সুশাসিত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ।