নারীরা এগিয়ে নেবে বাংলাদেশ
আমাদের দেশের নারীরা এগিয়ে চলেছে। নারী-পুরুষের মধ্যে সৃষ্ট সকল বাঁধা অতিক্রম করে প্রগতির পথে হাঁটছে তারা। আমাদের নারীরা লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে এভারেস্ট জয় করেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের নারীরা দেশের হয়ে ভূমিকা রাখছে। পরিবার, সমাজ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, রাজনীতি, পররাস্ট্রনীতি এবং প্রশাসনের সব ক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের নারীরা এক একনজন বাংলাদেশ হয়ে উঠবে। এজন্য আমাদের সহযোগী হয়ে তাদের পাশে থাকতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হলে নারীরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবেই। তার প্রমাণ রাখতে শুরু করেছে আমাদের কন্যা, জায়া, জননীরা।
কবি রবিউল হুসাইন তাঁর একটি কবিতায় লিখেন, ‘মানুষেরা নাকি এক সেকে-ে চার ফুট হাঁটতে পারে সাধারণত’। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি কবিতাটি লিখেছিলেন। মূলত স্বাধীনতার ২০ বছরের এগিয়ে চলার কথা বলেছেন। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। তখন দেশে ১২ কোটি মানুষ ছিল। আজ ১৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। তিনি তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘বারো কোটি মানুষ আমরা, আমরা সবাই একসঙ্গে হাঁটলে মোট আটচল্লিশ কোটি ফুট, অর্থাৎ ষোল কোটি গজ, তার মানে, এক সেকেন্ডে প্রায় নব্বই হাজার নয়শ দশ মাইল এগিয়ে যেতে পারি। স্বাধীনতা পাওয়ার পর বিশ বছর পার হয়ে গেছে, অথচ আমরা সবাই একই জায়গায় একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৌড়িয়ে মরছি সব সময়, এক ইঞ্চিও অগ্রসর হতে পারছি না’।
কবি রবিউল হুসাইনের লেখা থেকে বোঝা যায়, স্বাধীনতার পর আমাদের প্রগতির পথে চলা সুগম ছিল না। নানা ছল চাতুরি দিয়ে আমাদের সামনে পা ফেলা বন্ধ ছিল। আসলে আমরা কখনো একত্রে সামনে পা-ই ফেলিনি। যখন আমরা সামনে পা ফেলেছি, তখন বড় একটা অংশকে বাদ দিয়ে সামনে যাবার চেষ্টা করেছি। তাইতো মনে হয়েছে একই আবর্তে ঘুরেছি। তাই সামনে যাওয়ার গতি মন্থর। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে রেখে আমরা পুরুষরা এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি। সেজন্যই আমরা যেখানে থাকবার কথা সেখান থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। তবে কবির ওই কবিতা লেখার সময় েেথকে আমরা একত্রে পা ফেলে ফেলে এগোবার চেষ্টা শুরু করেছি। তাই তো আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের সারিতে অবস্থান করছি। এই সম্ভাবনার জন্য কেবল পুরুষ নয়, নারী পুরুষের একযোগে চলার ফসল।
বাংলাদেশ বিনির্মাণের পর আমাদের স্রোতের বিপরীতে চলতে হয়েছে অনেক দিন। তখন আমাদের নারী শিক্ষাকের পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। নারীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে অনেকটা প্রতিবন্ধকতা ছিল। সেই প্রতিরোধের দেয়াল চূর্ণ হয়েছে বলা যাবে না। তবে যে কোন সময়ের চেয়ে সেই দেয়ালের উচ্চতা কমেছে। ইচ্ছে করলে ওই দেয়াল টপকানো যায় এবং যাচ্ছে। তার প্রমাণ আমাদের নারীরা। প্রগতির পথে দেশ চলার সঙ্গে সঙ্গে নারীরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিতে সার্বিকভাবে ভূমিকার রাখার সুযোগ পাচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান এখন আস্থার স্থানে।
এক সময় ছিল তুমি নারী। তুমি হবে কোমল। তোমার এতো কথা বলার দরকার কি? তুমি অবলাই থাকো। তোমার জন্য বেশি শিক্ষার দরকার নেই। চাল-ডাল আর টাকা-পয়সার হিসাবটুকু জানলেই হবে। নারীর প্রতি এই বৈষম্যর কারণে এখনো নারীরা সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারছে না। কেউ একটু এগিয়ে যেতে চাইলেই তাকে পেছন থেকে টেনে ধরা হতো। তারপরও থামতে না চাইলে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী এবং কটুউক্তি দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হতো। তারপরও নারীরা এগিয়ে চলছে। নারী শিক্ষায় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী এবং কালো অধ্যায় না থাকলে আমাদের মেয়েরা, আমাদের নারীরা বাংলাদেশকে আরো সামনে এগিয়ে নিতে পারতো। সম্ভাবানার বাংলাদেশ বিনির্মাণে নারীরা আরও ভূমিকা রাখতে পারতো।
এতো এতো প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও নারীরা ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে চলছে। সুযোগ পেলে নারীরা যে এগিয়ে যায় তার প্রমাণ বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সকল অর্জনে নারীর ভূমিকা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে চলা সম্ভাবনার পর সম্ভাবনা জাগাচ্ছে। আমাদের কন্যা কিংবা মেয়ে কিংবা নারীরা এই সম্ভাবনা অব্যাহতভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত ছুঁয়েছে।
এ বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষার্থীদের হাতে স্বর্ণ পদক তুলে দিয়েছেন। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মেয়ে। আর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীর মধ্যে চারজনই মেয়ে। প্রাথমিক, মাধ্যমিকে সেরা মেধাবীদের তালিকায় আমাদের মেয়েরাই এগিয়ে আছে। প্রতিযোগিতামূলক সকল পরীক্ষায় মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক, চিকিৎসক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রকৌশলী, পাইলট, উপসচিব, সচিবসহ সব পদেই মেয়েদের জয়জয়কার। যদি মেয়েদের এগিয়ে চলার পথ সুগম হতো তাহলে বাংলাদেশকে আরো একধাপ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো।
আমরা মেয়েদের যে সম্ভাবনার কথা বললাম সেটা মেয়ে বা নারীদের পুরো চিত্র নয়। যারা সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে তাদের একটা অংশ। এর বাইরে অনেক মেয়ে, কন্যা এবং নারী আছে যারা বাধা অতিক্রম করতে পারেনি। তারা আগেই ঝরে গেছে। ঝরে গেছে বলছি কেন? ঝরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। অনেক মেধাবী কন্যা বাধ্য হয়ে বাল্য বিয়ে কিংবা আত্মহত্যা করেছে।
মেয়েদের যদি নিরাপত্তার নিয়ে ভাবতে না হতো, যদি তেঁতুল হুজুরদের নেতিবাচক বক্তব্য শুনতে না হতো, অকালে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে না হতো, মেয়েরা যদি মুক্ত মনে চলতে পারতো তাহলে অর্জনের ঝুলি অন্যরকম হতো। তারা বাংলাদেশটাই বদলে দিতে পারতো। আমরা চাই, পরিবার, সমাজ এবং রাস্ট্রের সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক, মেয়েদের নারী বলে অবহেলা করা বন্ধ হোক, নিরাপত্তার অজুহাতে বাল্যবিবাহ বন্ধ হোক। একই সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটুক। নারী-পুরুষের একসঙ্গে চলার গতি আরো বাড়ুক। এক সেকে-ে আমরা নব্বই হাজার নয়শ দশ মাইল নয়, লাখ লাখ মাইল সামনে যাবো। আর সেটা সম্ভব করতে পুরুষদের সঙ্গে আমাদের নারীরা সমানভাবে পা ফেলবে।