বাংলাদেশের ৫০, তন্ময় এর রক্তদানের ৫০

একজন মানুষ অন্য মানুষকে বাঁচাতে ৫০ ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন। মানে ২৫ লিটারের বেশি রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের ৫০ বছরের অর্থাৎ সুবর্ণ জয়ন্তীর ইতিহাসের পাশে নিজের নাম লেখিয়েছেন এক তরুন। কোন রকম বিনিময় না করে কেবল স্বেচ্ছায় এবং মুমূর্ষু রোগীর বিছানার পাশে গিয়ে রক্ত দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করা তরুণের নাম তন্ময়। পোশাকী নাম তন্ময় কুমার নাথ।
ফোটা ফোটা রক্ত ঝরতে ঝরতে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। আবার ফোঁটা ফোঁটা রক্তে মৃত্যুর মুখ থেকে সজিব হয়ে ওঠে মানুষ। কিন্তু যিঁনি বা যারা ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত বিলিয়ে দেন কেবল মানুষকে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে। তিনি বা তাঁদের এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের আরেক নাম হচ্ছে বাংলাদেশ। এটা লাল-সবুজের বাংলাদেশের ইতিহাস। এই ইতিহাস রচনা করে চলে বাংলাদেশের তরুণরা। সেরক ইতিহাস সৃষ্টি করা তরুণ তন্ময়।
ভূপেন হাজারিকা গানের মধ্যে বলেছিলেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু?’ হ্যাঁ একটু সহানুভূতি মানুষ পেতে পারে সেই প্রমাণ বারে বারে দিয়ে আসছে তন্ময় কুমার নাথ। রক্তদানের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন আনন্দ, গর্ব, প্রেম, ভালোবাসা। তাই বারে বারে ছুটে চলে ওই সকল মানুষের পাশে যাদের এক ফোঁটা রক্তে জীবন বাঁচে। এক ফোঁটা রক্ত দান করতে করতে তন্ময় নাথের ৫০ ব্যাগ রক্ত দান করা হয়েছে। গত ২৩জুন বুধবার তিনি তাঁর রক্তদানে ৫০ এর ঘর ছুঁয়েছেন। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসের সঙ্গে ছোট্ট একটা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তরুন বন্ধু তন্ময় কুমার নাথ। তাই বলাই চলে বাংলাদেশের ৫০ এর সঙ্গে তন্ময় এর রক্তদানের ৫০ পূর্ণ হলো।
তন্ময় কুমার নাথ এই ৫০তম ব্যাগ রক্তদান বাংলাদেশকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যাদের রক্তে ভিজে আজকের এই বাংলাদেশ সেই শহীদদের প্রতি রক্তদানের মাধ্যেমে স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীতে আমার শ্রদ্ধা। আমার ক্ষুদ্র জীবনে একটা পরিকল্পনা আজ পূর্ণ হয়েছে।’ রক্তদানের যোদ্ধা তন্ময় কুমর নাথ পূর্বে পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন বাংলাদেশের সূবর্ণ জয়ন্তীতে তার ৫০তম ব্যাগ রক্ত দান করবেন। তিনি তাই করেছেন। বাংলাদেশকে জানিয়েছেন তার ভালোবাসার কথা।
২০০৫ সালের ৬ অক্টোবর বরিশালে সন্ধানীর রক্তগ্রহণ কর্মসূচিতে প্রথম রক্তদান করেন তন্ময়। তখন থেকেই রক্ত দেওয়া আগ্রহ তৈরি হয়। প্রথম দিকে দুই একবার সন্ধানীতে রক্ত দিলেও এরপর সরাসরি মুমূর্ষু রোগীর বিছানার পাশে গিয়ে রক্ত দিয়েছেন। দিন-রাত্রি নাই জীবন বাঁচাতে রক্ত নিয়ে ছুটেন অন্য একটি জীবনের কাছে। আর তিন মাস পরপরই রক্ত দিয়ে চলেছেন তন্ময়। আজ সেই অনুভূতি প্রকাশের সময়।
প্রথম আলোর বন্ধু সভার একজন বন্ধু ছিলেন তন্ময়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় বন্ধুসমাবেশে বেশ কয়েকজন সেরা বন্ধুকে খুঁজে ছিলেন বন্ধুসভা। তখন তন্ময়কে পেয়েছিল ‘সেরা রক্তদাতা’ হিসেবে। ওই সময় পর্যন্ত তন্ময় ৪০ ব্যাগ রক্ত দান করেছিল। সেই দিনও বাংলাদেশ দেখেছিলো ‘সেরা রক্তদাতা’ তন্ময়কে। ফোঁটা ফোঁটা রক্তই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সেই রক্ত অন্যকে দিয়েও আনন্দ পাওয়া যায়? হ্যাঁ, সেই আনন্দই পেয়েছে। তাই তন্ময় রক্তদানে থেমে যায়নি। স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে চলা বরিশাল বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি তন্ময়ের অন্য রকম এক অনুভূতি, রক্ত দিয়ে হাসি ফুটিয়ে চলছেন মুমূর্ষু রোগীর মুখে। তাঁর ইচ্ছা, যত দিন রক্ত দেওয়া সম্ভব, তত দিন রক্ত দিয়ে যাবেন।
তন্ময় নিজে যেমন রক্ত দিয়ে চলেছেন, তেমনি অন্যদের রক্ত দিতে উৎসাহ যুগিয়ে চলছেন। তাঁর এই কাজে অনেক বন্ধু অংশ নিয়েছেন। তাঁরাও এখন রক্তদান করেন। রক্ত দিয়ে তন্ময়ের একটি নতুন উদ্যোগ ছিলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) স্ট্যাটাস দেওয়া। তাঁর সঙ্গে যাঁরা ফেসবুকে আছেন, তাঁরা যেন বিষয়টি জানেন। জানেন তাঁদের বন্ধুরাও। তাই রক্ত দরকার হলেই ইনবক্সে অনুরোধ জানান তাঁরা। আর তাতেই সাড়া দিয়ে হাজির হন তন্ময়। এভাবেই একে একে তন্ময়ের অনেক বন্ধুরাও তাঁর সঙ্গী হয়েছেন। চলমান মহামারীর মধ্যেও তন্ময় বেশ কয়েক বার রক্তদান করতে ছুটে গেছেন হাসপাতালে।
‘রক্তদানে বদলাচ্ছে মানসিকতা’। দেশে এখন রক্তদান নিয়ে অনেক সংগঠন কাজ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও বেশ সাড়া পাওয়া যায়। যার মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। কিন্তু চলমান ‘কোভিড-১৯’ এর প্রকোপে অধিকাংশ শিক্ষার্থী শহর অঞ্চলে নেই। যাদের অনেকই এখন নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাই রক্তের চাহিদা থাকলেও এখন রক্ত পেতে খুব কষ্ট হচ্ছে রক্ত গ্রহীতাদের। তাই ব্যক্তির নিজ নিজ অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব জীবন বাঁচাতে রক্তদানে এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেছেন তন্ময় কুমার নাথ।