মঠবাড়িয়া ২৫১ মূর্তি ও সেবার ব্রত নিয়ে দূর্গা উৎসব

মঠবাড়িয়া ২৫১ মূর্তি ও সেবার ব্রত নিয়ে দূর্গা উৎসব

প্রকৃতিতে কাশফুলের শুভ্র আলিঙ্গন। সাদা মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে চারদিকে।। আসছে দুর্গতি নাশিনী দেবি দুর্গা। মা ধরায় আসছে নিয়ম মেনেই। অশুভ শক্তি বিনাশ করে প্রকৃতিতে শান্তির পরশ দিয়ে আবার ফিরে যাবেন মা, এমনই প্রত্যাশা সনাতন ধর্মের ভক্তদের। তাই দূর্গা পুজা আজ ধর্মীয় গন্ডি ছাড়িয়ে সামাজিক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। ব্যতিক্রমী নানা আয়োজনে দুর্গোৎসব সমাজ সচেতনতা এবং মানবতার জয়গানে মেতেছে মঠবাড়িয়ায় ডাক্তার দম্পতি। 

দুর্গা পূজা আয়োজনের মাধ্যমে ধর্মীয় পৌরানিক ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সমাজের বিভিন্ন ইতিবাচক দিক তুলে ধরে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন চিকিৎসক সুদীপ হালদার। ২৫১ দেবদেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে এবছর দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছেন তিনি। 

২০১৯ সালে ৩৩৩ দেব দেবতার মূর্তী দিয়ে পূজা উদযাপন করেছিলেন করোনার আক্রমনের কারনে গতদুই বছর নিয়ম মেনে ছোট আয়োজনে পূজা উদযাপন করেছেন তবে এবছর নতুন থীম নিয়ে জনসচেতনতা ও সেবার ব্রত নিয়ে শারদীয় উৎসব উদযাপন করবেন। তিনি দুর্গোৎসবের মাধ্যমে মানবতার আহ্বান জানিয়েছেন। 

বরিশাল বিভাগের ব্যতিক্রমী এই আয়োজন বসেছে পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার গুলিসাখালী ইউনিয়নের কবুতরখালী গ্রামের রাজ মন্দিরে।

এই আয়োজন করে সাড়া ফেলেছেন বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট  অর্থপেডিক্স ও সার্জন  ডাক্তার সুদীপ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী শেরেই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনী বিশেষজ্ঞ  ও সার্জন ডাক্তার স্নিগ্ধা চক্রবর্তী। 

বছর জুড়েই ডাক্তার দম্পতি দুর্গা পূজা নিয়ে মেতে থাকেন আয়োজনের বিষয় গুলো দেখেন সুদীপ হালাদারের বাবা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শৈলেশ্বর হালদার।

বাড়ির প্রবেশ পথে লেখা রয়েছে রাজ মন্দির। প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে শারদীয় দুর্গা উৎসবের আয়োজন দেখা যায়। দুর্গা পূজার মাধ্যমে মানবতার আহ্বান জানানো,ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক মিলনমেলার আয়োজন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন রাজ মন্দিরের স্বত্তধিকারী ও তার পরিবার।

নারী সমাজকে প্রধান্য দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিমাগুলো। পূজার মাধ্যমে সমাজের চার মাস ধরে চিত্র ফুটিয়েছেন মৃৎশিল্পী শঙ্কর পাল।সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ কলিযুগের বিভিন্ন দেব দেবতার মূর্তী তৈরি করে বিশেষ আকর্ষন করেছেন।

এছাড়াও দূর্গা মন্দিরের সাথে কালী মন্দির, মনসা মন্দির, শিব ঠাকুর, বাবা লোকনাথ মন্দির, সরস্বতী মন্দির, মতুয়া মন্দির।

দুর্গোৎসবে থাকছে ৫২ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ আর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদানের কাহিনী, পদ্মা সেতুর আদলে সেতু তৈরি করে বঙ্গবন্ধু কর্ণার,শেখ হাসিনা কর্নার,শেখ রাসেল কর্নার, মাতৃদুগ্ধপানের কর্ণার, স্বাস্থ্য কর্ণার, ধূপ কর্ণারসহ নানা নায়োজন। প্রজেক্টরে বিগত বছরে প্রামান্য চিত্র এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষন দেখানো হবে।তবে বিশেষ আয়োজন সেবা প্রদান চার দিনের মেডিকেল ক্যাম্প সপ্তমী থেকে দশমী। ব্রেস্ট ফিডিং কর্নারের মাধ্যমে প্রতিদিন সেনিটারি প্যাড বিতরণ করা হবে নারীদের। দুঃস্থদের জন্য বস্ত্রদান, অস্বচ্ছল মেধাবিদের  শিক্ষার্থীদের সহায়তা। এ ছাড়াও আগত দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন ২০০০ লোকের খাবার ব্যবস্থা করে আয়োজনকারীরা। 

দুর্গা পুজার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার আকাঙ্খা আয়োজনকারীদের।

সরেজমিনে চিকিৎসক সুদীপ হালদারের বাড়িতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে রাজমন্দির। রাজ মন্দিরই বটে। এই রাজ মন্দিরের বিশাল আঙিনা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে দুর্গোৎসবের প্যান্ডেল। প্রবেশ পথ থেকে মন্দির পর্যন্ত ৫ টি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে।  সারিবদ্ধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিমা।  ২৫১ দেব-দেবীর প্রতিমা নির্মার্ণের মাধ্যমে এই মন্দিরে চারহাজার বছরের পুরানো পৌরাণিক কাহিনীকে তুলে ধরা হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সঠিক পথে আগ্রসরের তাগিদ দিতে গ্রাম জুড়ে গাছের সঙ্গে সাটানো হয়েছে  বিভিন্ন উপদেশ মূলক বাণী।

মন্দিরের আঙিনায় হাঁটতে হাটতে আয়োজন নিয়ে কথা চলে সুদীপ হালদারের সঙ্গে পারিবারিক ভাবে এই বৃহৎ দূর্গোৎসবের আয়োজন বিভাগ জুড়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। উৎসহ-উদ্দিপনা দেখা গেছে স্থানীয়সহ বিভাগের  সব ধর্মের মানুষের মাঝে। প্রতি বছরের মতো এই উৎসবকে ঘিরে তাদের কবুতরখালীর হালদার বাড়িটি পর্যটন এলাকায় পরিণত হবে উৎসবের দিনগুলো।

পূজার সার্বিক দিক নিয়ে ডা. সুদীপ হালদার ভোরের আলোকে জানান, এ বছর তিনগুণ পুজারী ও দর্শনার্থীর সমাগম হবে। প্লক্ষাধিক মানুষের মিলনমেলা বসবে এবারের দুর্গোৎসবে। ইতোমধ্যে প্রশাসনের সহযোগীতা পেয়েছেন  এবং উৎসবের দিনগুলো কামনা করছেন।  প্রথম ৪০টি প্রতিমা নিয়ে এই মন্দিরে পূজার আয়োজন করা হয়। তখন থেকেই দুর্গা পূজাকে সব ধর্মের মিলনক্ষেত্র এবং সমাজের ইতিবাচক বিষয় তুলে ধরার আকাঙ্খা ছিল। সেই আকাঙ্খা থেকে দ্বিতীয় বছর ১৫৭টি প্রতিমা ও ২৫টি মন্দির নির্মাণ করা হয়। এ বছর ২৫১ প্রতিমা ও অর্ধশত মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রতিমাগুলো সনাতন ধর্মের ইতিহাস। এর মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার ইচ্ছা রয়েছে। সামাজিক সেতুবন্ধ রচনায়  বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন অংশ তুলে ধরা হচ্ছে পূজার মাধ্যমে। আগামী ১ অক্টোবর পূজার কার্যক্রম শুর হবে।

চিকিৎসক স্নিগ্ধা চক্রবর্তী বলেন, দুর্গা পূজা উপলক্ষে ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুরে চলে গণভোজ। এই ভোজে অংশ নেয় শতশত মানুষ। পূজা উপলক্ষে ভোজ করিয়ে তিনি ও পরিবারের সদস্যরা আনন্দ পান। সাথে যারা স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন তাদের পোশাকে এমন শ্লোগান উল্লেখ্য থাকবে।

খুলনা চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃৎশিল্পে প্রশিক্ষণ পাওয়া সাতক্ষীরা জেলার প্রতিমা নির্মাণ শিল্পী শংকর মন্ডল বলেন, গত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে প্রতিমা নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। এত বড় আয়োজন আমার জানা মতে বাংলাদেশে আর কোথাও হচ্ছে না। বড় একটি আয়োজনের সঙ্গে থাকতে পারার আনন্দ বলে বোঝানো সম্ভব নয়। প্রতিমা নির্মাণ শেষ হয়েছে। এখন চলছে রঙ-তুলির কাজ। পূজোর  সাজ-সজ্জা শেষ।  এমন কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে চান এই মৃৎশিল্পী শংকর মন্ডল।

ব্যতিক্রমী দুর্গোৎসবের আয়োজক ডা. সুদীপ হালদার তাঁর বাড়ির এই আয়োজন দেখতে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।