সাংবাদিক রোজিনাকে হেনস্থা-মামলা অগ্নি আখরে পুড়িয়ে দিতে হবে জঞ্জাল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। কোন আগুনে শুচি হবে ধরা। শুভ্র-শুচি হতে হলে দুষ্টক্ষত, জঞ্জাল-আবর্জনা পুড়িয়ে ছাপ করতে হবে। সে আগুন কে জ¦ালাবে? এতো আবর্জনা পোড়ানো কি সম্ভব? কে বলেছে সম্ভব নয়, অবশ্যই সম্ভব। ওই আগুনের ফুলকির বিচ্ছুরণ শুরু হয়ে গেছে। একজন রোজিনা ইসলামকে নির্যাতন ও মামলা দিয়ে আগুন জ¦ালানো হয়েছে। সেই আগুন জ¦ালিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজরা। তারা জানে না, ছাইচাপা কিংবা তুষের আগুন সহজে নেভে না। এটা কোন সতর্কবাণী নয়, অতি পরাবাস্তব। প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম আজ আর একটি নাম নয়, হাজার হাজার রোজিনাদের প্রতিনিধি হয়ে জ¦লে উঠেছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের নাম হয়ে গেছে রোজিনা ইসলাম। এই আগুন নেভানো যাবে না। রোজিনাদের আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জঞ্জালসহ সব অশুভ শক্তি।
আমরা দিন দিন আজব পশুবৃত্তি রচনা করে চলেছি। আমাদের লজ্জা হচ্ছে, ঘৃণাও জন্মেছে, সাধারণ মানুষের রক্ত-ঘামের দামে তৈরি উপসচিব, সচিবদের আচরণ দেখে। স্বাস্থ্য বিভাগের সাগর চুরির সঙ্গে জড়িতদের আষ্ফালন দেখে। এমন সন্ত্রাসী আচরণ তো করার কথা সুবিধা বঞ্চিত অসহায় মানুষদের। দেশের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা নোংড়া পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মতো আচরণ করবে এমনটা প্রত্যাশা করে না মানুষ। যাদের ঘাম চুরি করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় রচনা করে চলেছেন, সেই আপনাদের দম্ভ কমান। আপনারা একজন রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে নির্যাতন করে মামলা দিয়ে যে আগুন জ¦ালিয়েছেন, সে আগুনে আপনাদেরই পুড়তে হবে। আপনাদের পুড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে শুদ্ধ করতেই হবে।
আমরা হতবাক হয়েছি, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে অনুসন্ধানী প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে হেনস্তা এবং রাতে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে যেভাবে নথি চুরির মামলা দেওয়া হয়েছে সেই প্রক্রিয়া দেখে। কারা দীর্ঘ সময় রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে মামলার জালে আটকানোর ব্যবস্থা করেছে তাদের প্রতি ঘৃণা জানাই। একই সঙ্গে এ ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। অবিলম্বে রোজিনা ইসলামের নামে দেওয়া মামলা প্রত্যাহার এবং নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি করছি। এই দাবি পূরণ না হলে সারা দেশে যে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে তার আচ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল।
আমরা জানি, করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের ক্রয় থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। সারা দেশের গণমাধ্যম কর্মীরা সাধারণ মানুষের সামনে যে চিত্র তুলে ধরেছে তা ছিল অবিশ^াস্য এবং ভয়াবহ। স্বাস্থ্যখাতের যে ভয়াল ও অমানবিক চিত্র জাতির সামনে এসেছে, তার অনেকটাই সম্ভব হয়েছে রোজিনা ইসলামের মতো নির্ভিক গণমাধ্যমকর্মীদের নিরন্তর প্রচেষ্টা ও নিষ্ঠার কারণে। সরকারি নথি চুরির অভিযোগ এনে দীর্ঘসময় ধরে একজন নারী সংবাদকর্মীকে আটকে রেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যে ধরণের নিপীড়নমূলক আচরণ করেছেন তা মুক্ত সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হুমকী স্বরূপ। রাস্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হচ্ছে গণমাধ্যম। সেই গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরার নগ্ন উদারণ সৃষ্টি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব উপসচিবরা। এর নিন্দা জানালে হবে না। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সাংবাদিকদের আশ^স্ত করতে হবে। তা না হলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পরতে পারে।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব আইনে মামলা হয়েছে তা বৃটিশ সরকারের আমলের আইন। একজন গণমাধ্যমকর্মীকে যেভাবে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার বিষয়কে টেনে এনে বৃটিশ আমলের ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩’ এর ৩ ও ৫ ধারা এবং পেনাল কোডের ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। কেবল রোজিনা ইসলামকে ফাঁদে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়েছে। যখন তথ্য অধিকার আইন কার্যকরের সময় তখন পুরানো আইনের যাতাকলে নিষ্পেষণের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল রোজিনা ইসলামকেই নয়, পুরো গণমাধ্যমকেই অপচেষ্টার জালে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির মতে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে নিবর্তনমূলক ৩২ ধারায় ঔপনিবেশিক আমলের ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩’ সন্নিবেশনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো রোজিনা ইসলামের ঘটনার মধ্য দিয়ে তার নগ্ন পরিণতি পেয়েছে।’ টিআইবি এর নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ‘আমরা কী সামনের দিকে এগোচ্ছি না-কী উল্টো যাত্রা শুরু করেছি? এর শেষ কোথায়! এক শ্রেণির অসাধু, নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকর্তা ও উচ্চ পদে আসীনদের কাছে সরকার কী ক্রমাগত জিম্মি হয়ে পড়ছে!’
আমরা বিশ^াস করি, বর্তমান সরকার কোন আমলা সচিবের কাছে জিম্মি নয়। সরকার বিষয়টি ইতবাচকভাবে দেখবে। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ সচিব, উপসাচিবদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকারের সেই দূরদৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকবে গণমাধ্যম। রোজিনা ইসলামের প্রতি যে অন্যায় ও অন্যায্যতা হয়েছে তার প্রতিকার না পেলে গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতাই মূলত হুমকীর মুখে পড়বে।
আবারো রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে শেষ করতে চাই, ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেল, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে।’ রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে নির্যাতন ও মামলা দিয়ে যে আগুন জ¦ালিয়েছে মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ সচিব, উপসচিবরা সে আগুন আপনার, আমার প্রাণসহ ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা দেশের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, সংগঠনকর্মীরা এক হয়ে আগুনে আহুতি দিচ্ছে। ঐক্যবদ্ধ গণমাধ্যম আজ একপথে এক আওয়াজ তুলেছে। রোজিনা ইসলামের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কেবল বিচার নয়, যাতে আর এধরণের ঘটনা না ঘটে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এ আগুন নেভাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে দায় নিতে হবে সরকারকেই।