করোনায় বাড়ছে বাল্য বিবাহ

করোনায় বাড়ছে বাল্য বিবাহ

করোনাকালে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বাল্য বিবাহ। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৫১ ভাগ মেয়ে শিশুর বিয়ে হয়ে হচ্ছে। মেয়েশিশুর সব থেকে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহের ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নিজের মতো জীবন যাপন করতে পারে না এসব শিশুরা। সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতা, আইনের প্রয়োগ, নজরদারি এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো গেলে দেশ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব। তবে করোনাকালের বিষয়টি মাথায় রেখে বাল্যবিবাহ বন্ধে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে।

গত বুধবার রাতে ‘সদ্য বিবাহিতা প্রচারাভিযান শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে অংশ নিয়ে এসব শঙ্কার কথা বলেছেন আলোচকেরা।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ আয়োজিত ভার্চুয়াল সংলাপে সংস্থাটির ডিরেক্টর ফিল্ড অপারেশন (জোন-২) লিমা হান্না দারিংয়ের সভাপতিত্বে ওই ভার্চুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশালের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (উপসচিব) মো. শহীদুল ইসলাম। প্যানেল আলোচকদের মধ্যে ছিলেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দিলারা খানম, প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ, সাংবাদিক সাইফুর রহমান মিরণ, নারী নেত্রী রহিমা সুলতানা কাজল, প্রতীকি যুব সংসদের চেয়ারপার্সন আমিনুল ইসলাম (ফিরোজ মোস্তফা) প্রমুখ। এতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন বরিশাল ইয়ুথ ফোরামের প্রতিনিধি যুব সংগঠক সোহানুর রহমান। 
সংলাপে আলোচকেরা বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর বাল্যবিবাহের হার বাড়ছে। তবে করোনা মোকাবিলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রাণ বা অন্যান্য কার্যক্রম গুরুত্ব পেলেও বাল্যবিবাহ বন্ধের কার্যক্রম ততটা গুরুত্ব পায়নি। করোনায় বাল্যবিবাহ বন্ধ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেনি।

বরিশালের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক (উপসচিব) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘বাল্যবিবাহ রোধে বাংলাদেশ সরকার বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, নীতিমালা এবং বিধিমালা প্রণয়ন করেছেন। আমরা অনেক বিষয়ে এগিয়ে থাকলেও বাল্যবিবাহের দিক থেকে পিছিয়ে আছি। তবে বিধিমালায় বাল্যবিবাহ আটকানোর ক্ষমতা সরকারী পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। এজন্য সামাজিক আন্দোলনকে আরো জোরদার করতে হবে। বাল্যবিবাহের ফলে যে সকল শারীরিক সমস্যা হয় তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বর্তমানে বেশিরভাগ মামলা বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত। বাল্য বিবাহ বন্ধে শিক্ষা বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে তারা সুস্থ পরিবেশে পাঠদান গ্রহণ করতে পারে। অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব।’

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দিলারা খানম , ‘২০১৮  সালে বাংলাদেশ সরকার যখন বাল্যবিবাহ রোধে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে, তখন এর হার ছিল ৫২% । ২০২১ সালের মধ্যে এই হার ১৫% এর নিচে ও ২০৪১ সালের মধ্যে এই হার ০% এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু ২০২০ সালে বাল্যবিবাহের হার বেড়ে গিয়েছে। কারণ অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারি-বেসরকারী সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ইউনিয়ন কমিটি আরো মজবুত করতে হবে। আমাদের কাজের গুণগত দিক দিয়ে আগাতে হবে, পরিমাণগত নয়। আমাদের দেয়া প্রতিবেদনে ঘাটতি রয়েছে। আমাদের কাছে সঠিক তথ্য আসতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে তেমন কোনো কর্মী নেই। তাই সরকারি বেসরকারি কর্মীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং সুষম তথ্য দিতে হবে। তরুনরা বাল্যবিবাহ বন্ধে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কন্যার পাশাপাশি কিশোরদেরও সচেতন হতে হবে। মেয়েদের সম্পদে পরিণত করতে হবে।’

প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, ‘সাধারণত আর্থিক অসচ্ছলতা, অতিমারির কারনে এইসব শিশুদের বিবাহ হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর প্রচুর মামলা হয় যার মধ্যে প্রায়ই শিশু।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ কমানো সম্ভব। বাল্যবিবাহের আরেকটা বড় কারন হলো সামাজিক অবক্ষয়। আমরা সকলে প্রচার প্রচারণা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে এই বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারি যাতে আমাদের শিশুকন্যারা সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে।’

সাংবাদিক সাইফুর রহমান মিরণ  বলেন,  ‘আমাদের বরিশাল জেলাকে বলা হয় বাল্যবিবাহ মুক্ত জেলা। কিন্তু হিজলা, মুলাদি, মেহেন্দিগঞ্জে প্রতিনিয়তই বাল্যবিবাহ এর মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। কভিড এর সময় বাল্যবিবাহ দ্বিগুনেরও বেশী হচ্ছে। পরিবার যখন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তখন বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে যায়। শিশুদের দিকে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নজরদারি বাড়াতে হবে। বাল্যবিবাহ হচ্ছে করোনার সঙ্গে আরেকটি মহামারি। বাল্যবিবাহ বন্ধে পরিবার থেকে দাবি উঠতে হবে। আমরা চেষ্টা করি পত্রিকার পাতায় তথ্যগুলো তুলে ধরার। নারী শিশুদের সুরক্ষার জন্য নজর দিতে হবে। শিশু সংগঠন ও সংশ্লি¬ষ্ট সকলকে অংশগ্রহণ করতে হবে। তবেই বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে।’

নারী নেত্রী রহিমা সুলতানা কাজল বলেন, ‘আমরা কন্যা শিশুকে বধু হিসেবে দেখতে চাই না। কোভিড-১৯ কালীন সময়ে অনেক বাল্যবিবাহ হয়েছে কিন্তু আমরা জানি না। আমরা একটা সার্ভে করেছি যেখানে দেখেছি অজান্তেই ৯৫ শতাংশ মেয়ে শিশুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাড়িঘর ছেলে অন্যত্র চলে যাচ্ছে এবং যার ফলে তারা কন্যা শিশুকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে কাবিন ছাড়াই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে আমরা কোনো আইনি সহায়তাও দিতে পারছি না। এটিও একটি ভয়াবহ দিক। আমরা যদি এই বাল্যবিবাহ বন্ধ না করি তাহলে কখনোই সমাজ উন্নত হবে না।’

প্রতীকি যুব সংসদের চেয়ারপার্সন আমিনুল ইসলাম (ফিরোজ মোস্তফা) বলেন, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধ করার লক্ষে কয়েকটি ইউনিয়নকে মডেল ইউনিয়ন চিহ্নিত করে বাল্য বিবাহ বন্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করছে আমাদের সংগঠন। আমরা তরুন প্রতিনিধিদের ট্রেনিং করিয়েছি। কুসংস্কার এর জন্য অনেক জায়গায় বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে ভাঙতে গেলে চাঁদাবাজ হিসেবে দায়ী করে তরুন সমাজকে। বাল্যবিবাহ রোধ করার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তরুনদের সহায়তা করতে হবে। সব ভেদাভেদ ভুলে এগিয়ে আসতে হবে। সংশি¬ষ্ট সকলকে নিয়ে কমিটি করতে হবে। কমিটির মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে যাতে বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়।’

সভাপতির বক্তব্যে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ’র ডিরেক্টর ফিল্ড অপারেশন (জোন-২) লিমা হান্না দারিং বলেন, ‘প্রতি বছর ১২ মিলিয়ন শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়। যা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। প্রতি ১ মিনিটে, ২২টি শিশু বাল্য বিবাহের শিকার হয়। কভিড-১৯ এ এই সামাজিক ব্যাধি আরো ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। গত বছরে ২১টি জেলায় মোট ১৩ হাজার ৮৮৬ টি বাল্যবিবাহ সম্পন্ন হয়। বাল্যবিবাহ এর কারণে শিশুর মনোজাগতিক বিকাশ, প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি চাহিদা এর বেশ ক্ষতি হয়। জ্ঞানের পরিধি কম থাকায় তারা সার্বিক পুষ্টি চাহিদা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। যে হারে বাল্যবিবাহ বেড়েছে, এই হার কাম্য নয়। আমাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। দারিদ্র্যতা দূর করা, সুন্দর পরিবেশ, সামাজিক সুরক্ষা এবং কন্যাশিশুর নিরাপত্তার জায়গা গড়ে তুলতে হবে। যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের ব্যবহারিক দিক বাড়াতে হবে। আমরা যদি একসাথে রুখে দাড়াই, তাহলেই বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে। যে যেখান থেকে পারি আওয়াজ তুলতে পারি।